এই মাসের কবি : তিস্তা লাহিড়ী
আলাপ পর্ব
তিস্তা লাহিড়ী, বয়স ২৫ বছর। ২০২০ সালে সাংবিধানিক আইন নিয়ে ন্যাশনাল ল ইউনিভার্সিটি ওড়িশা থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। আপাতত সেন্টার ফর ডব্লিউ টি ও স্টাডিজ, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ফরেন ট্রেড এ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্ক বিষয়ে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কর্মরত। খুব কম বয়স থেকেই কবিতা লিখছে তিস্তা। কিন্তু খুবই অনিয়মিত। প্রকাশে তার সহজাত কুন্ঠা। ইদানিং কিছু পত্রপত্রিকায় কবিতা ছাপা হচ্ছে। তিস্তার প্রথম ও একমাত্র কবিতার বই "বেড়ালেরা প্রলেতারিয়েত" ২০১৮তে প্রকাশিত হয়েছে। সাংবিধানিক আইন ছাড়াও সাহিত্য সংস্কৃতি ও বিশেষ করে সিনেমা নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় । যার কিছু লেখা সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এছাড়াও নিজের গবেষণার বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রফেশনাল জার্নালে নিয়মিত লিখতেই হয় তিস্তাকে।
কবিতা
আর কিছুতেই যায় আসে না
ম্যাজিক কিংবা সত্যিকথার
এমন কিছু প্রবাদপুরুষ
হয়তো আছেন যাদের মাথার
দিব্যি গেলে বলতে পারি
যেমন যাচ্ছে তেমন চলুক,
আর কিছুতেই যায় আসে না।
জিন্দেগী তো বুকের ভেতর
এমন বিষম বৃহস্পতির
প্রকোপ, আমার সবাই থেকেও
একলা আমি নিজের ভেতর
পুকুর খুঁড়ে শাপলা-শালুক
ফোটাচ্ছি তাও ফুল ফোটে না
এবার চলো অন্য দীঘির
বুকের ভেতর কিংবা অথৈ
পেরজাপতির রঙীন ডানায়
সমুদ্রঝড় পূর্বাভাসই
সত্যি করি বরফজমি
সাইবেরিয়ায়। সন্ধ্যে হলো।
উপরতলার সাইবেরিয়ায়
সন্ধে হলো, হ্রদ খোঁজ আর
পদ্মকাঁটায় নিষ্ঠাপ্রিয়
বন্ধু খোঁজো সঙ্গীসাথী
এবং শ্যামের সমান মরণ --
ইকুয়েশন না পাওলো কোলো ?
চাঁদিম জলে শাপলাশালুক
তুলতে যাবো, হে কান্ডারি
যদিও আমার সবাই আছে,
এবং আমার নষ্টজমির
দাখিলপাতাও গুছিয়ে রাখা --
সুদক্ষিণী মৃত্যুফাগুন
কে চিনেছে হে কান্ডারি?
চাঁদপাওয়া না অংশগ্রহণ
ভয়ের গভীর শাপলা তলায়
ডান্ডা-গুলির জমিন, আমি
শালুক তুলি ভাসার আশা
তুচ্ছ করে, মৃত্যুপ্রসূন
গন্ধে মাতাল এমন আমি।
তখন নাহয় হে কান্ডারি,
হে বন্ধুধন মুদ্দোফরাস,
পৌঁছে দিও উর্দ্ধগামী
সে বন্ধুদের বলতো যারা
জলের তলায় এ ফসফরাস
সাপের মণি -- চিতার আগুন!
বিরহকবিতা
পাবলো নেরুদা -- হলুদ কবিতা
অথবা কেবল অন্ধ পাতায়
পিছল বৃষ্টি -- নিজেও নিজেকে
হাতে পাচ্ছি না -- শৈত্যপ্রবাহ !
ছন্দ মানে সে গোপন নিষ্ঠা
আবার তোমার ফর্সা কপালে
অশিষ্ট চুলে এলোমেলো কথা
আদর চাইছে -- শাসন করহ !
সন্ধ্যের পাখি মন জানালাতে
এখনো বাঁধিছে বুলবুলিবাসা --
গজলের মতো বিষন্নপ্রথা
শ্রেণীবিভাজনে অগোছালো স্নেহ।
অথবা যা ছিল -- হলুদ কবিতা
নেরুদার মতো আসলে কামুক
ধর্ষক- আর নিজেকে তো জানি --
অকর্মণ্য। মন -- শব দাহ
চিনে নাও , আর চিনে নাও যাকে
এখনো চেনোনি, প্রজাপতি চেয়েও
গূঢ়তত্ত্ব বিরহ অথবা
কেবলি বিরহ--বিরহ--বিরহ
গাছ
ভালোবাসা আসলে এক গাছ।
কোথায় শিকড় ওর? কোথায় শিকড় ওর মা'র?
ভালোবাসা আর অন্ধকার
মুখোমুখি ঘুম নিয়ে তাসপাশা খেলে নির্ভার।
ভালোবাসা আসলে ছায়াবাজি
আঙুলে আঙুল আলো, কথা হারাবার কারসাজি
ক্যালাইডোস্কোপের গুঁড়ো কাঁচ।
ভালোবাসা আসলে এক গাছ।
অক্সিজেন দেয়। তাই ঘেন্না সয়ে আজও বেঁচে আছি।
গাছ তাই প্রাণ, আর গাছ তাই এত নিঃসাড়।
কোথায় শিকড় ওর? কোথায় শিকড় ওর মা'র?
লগ্নিকথা
বলেছিল মাঝি,
ইহ জমি চাষ করা নেহাতই লোকসান হবে আজই
জমিজমা ভুলে
ফকিরি করিয়া যেও পথে পথে, সুদে বা মাশুলে।
বলেছিল মাঝি,
জলেরও গভীরে আছে গভীর জলের রংবাজি।
জীবন ও আজব, শালা, চীজ্,
সকালে হাতেমতাই, সন্ধে হলে হিজিবিজবিজ।
এসো দিয়ে যাও,
যা কিছু সহজে দেবে ফড়ে দালালের বন্দরে--
এসো দিয়ে যাও।
মায়ের জমিন ছিল, বাপের ফসল ছিল ঘরে।
দিয়ে দেব ঠিক।
এখানে আগুন, জল, সমন্বয় সবই আপেক্ষিক,
জড়সড় নাম।
শ্রম কিংবা ফসলের কে কবে দিয়েছে ঠিক দাম?
দোহাই আলী
এদিক শত্রু ওদিক শত্রু মধ্যিখানে চর
তার ওপরে ঠ্যাং ছড়ানো চাঁদ সওদাগর
ভাবছে বসে, এবার ডিঙি খুলবো কি খুলবোনা
জলের নীচে মাছের মায়ের আনমনা উলবোনা
খোকার ছিল বেড়াল কিন্তু আমার সাথে কে
এই অপরূপ ভাবনদীতে ডুবকি বাজাবে?
গান ও হলো স্নান ও হলো পকেট হলো পর
এপার শত্রু ওপার শত্রু মধ্যিখানে চর
গরুও ছিল গাড়িও ছিল নদীও ছিল ঘাটে
মিষ্টিমাছে কৃষ্টিসুখে দিবসখানি কাটে
জলের নীচে মাছের মায়ের দুচোখ ছলছল
দোহাই আলী, হাত ভরে দাও রাজসূয় সম্বল
তাহার পরে দেখিয়ে দেব কলা এবং রথ
কেমন করে বিক্রি করে। হরি ওঁ তৎসৎ!
নিভৃতজন
মনের মধ্যে আরেকটা মন
বাঘ মেরেছে মহোৎসবে,
বন্ধু চলো শিকার ধরি।
হন্যে হয়ে নিভৃতজন
উপাসনায় মগ্নভাবে
খুঁজিতেছেন স্বপ্নপরী,
বন্ধু চলো শিকার ধরি।
সাতসমুদ্র ফাঁদ পাতিব,
শুকনোরাতে চাঁদের খড়ি
ফুটছে আকাশশরীর জুড়ে,
হয়তো এবার ঠিক পারিব
ধরতে সবুজ পান্না-ফড়িং
হিংসে-রকম বিষের বড়ি।
উপাসনায় তলিয়ে আছেন নিভৃতজন
হন্যে হয়ে খুঁজতে হবে
অ্যাটলান্টিস স্বপ্নপরী।
বন্ধু, চলো মহোৎসবে
এই সুযোগে শিকার করি
মনের ভেতর আরেকটা মন।
উপাসনায় তলিয়ে আছেন নিভৃতজন।
প্যাসেঞ্জারি
ফেরার রাস্তা জুড়ে শহরের এলোমেলো তার।
এখানে যমুনা ট্রেন, আর ট্রেন ডেলি প্যাসেঞ্জার।
মনখারাপের ক্ষেতে কি দিয়েছে জল, বনমালী?
জল না বিফল-কল? অথবা চাঁদের এক ফালি
ফয়েলে মুড়িয়ে দিলে ভাসিয়ে ট্রেনের কালো স্রোতে?
রাধা কি এখনও জানে বাঁশিটি কাহার নীল ঠোঁটে?
গীতা পড়। মাফলেষু কদাচন । সদা-কাজ ব্রত,
তোমার খাতাটি পেলে হয়তো বা সম্ভব হতো,
কিন্তু মনের তাকে, হায় প্রিয়, ঘুণপোকা ধরে।
দুই বছরের কাজ শেষ করি দশ বৎসরে।
ফল বা শিকড় হোক। আলসেও। কার্নিশও বটে।
যেটুকু বুদ্ধি আছে, সেটুকুই ঘটে- সংকটে
মাঝেমাঝে নাড়ি, আর মাঝেসাঝে ঘোর সংসারী।
যমুনার ট্রেন ধরে চলিয়াছে আকামের ধাড়ি।
সব ব্যাটা গেলে থাকে বেঁড়ে ব্যাটা। বিধি মোর বাম।
একটা শালিখ দেখে সত্য মনে হয় রামনাম।
হতাশা যখন রেল, তখন আর ভয় কি শালিখে?
একলা অভাগা পাখি উড়ে যাবে, ভাঙা পিকনিকে।
বাকি থাকি আমি, তুমি, কাজ, ট্রেন, এলোমেলো তার।
ক্লান্তদিনের শেষে ভাত ছাড়া আর কি চাওয়ার?
জারুলগল্প
জারুলফুলের মতো নরম গল্পগুলো
কখনো ছুটির দিনে কোল ঘেঁষে বসে থাকে,
যেন বা মেলায় গিয়ে হঠাৎই আঙুলখানা
আমার মুঠোর থেকে নিমেষে ফস্কে গেছে,
আমিও বোকার মতো ,আমিও ল্যাবার মতো
মাঠের মধ্যিখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছি
জিলিপির সুখ ভুলে। কিংবা যখন তুমি
আমাকে দেখিয়েছিলে বালুতে ভরাট জমি
মরা নদী, ফুল-বাসা বেঁটে বেঁটে কুলবনে
ছোট পাখি বেঁধেছিলো, ততটাই আজগুবি।
যদিও কখনো দিন এমনও পশম হয়,
পাথরে স্বপ্ন দেখা তুলো তুলো ভেড়াগুলো
আকাশে উজিয়ে আসে হড়পা বানের মতো,
এবং যদিও তুমি অন্য শহরে থাকো,
জারুলফুলের মতো স্পষ্ট স্বপ্ন দেখে
তোমাকেও পাওয়া যায়। এইখানে। আলুথালু।
জ্যৈষ্ঠ যেমন করে দুপুরে-বিকেলে খেলে
টিউকল জল খায় অঞ্জলি ভ'রে, আমি
তেমনই অসংযত হাত-মুখ ধুয়ে নেবো
তোমার স্নিগ্ধতায় , দেবে বলো তুমি? দেবে ?
যদিও আজকে দিন স্বপ্নভোলার দিন,
ঘরের বদ্ধদিন , আড়াল-ছদ্মদিন,
যদিও এমন দিনে আমি আর তুমি শুধু
দূরে যাই , দূরে যাই , আরো আরো দূরে যাই,
তারাদের থেকে দূরে, পরীদের থেকে দূরে ,
জাহাজের থেকে দূরে, নদীদের থেকে দূরে,
এবং জারুলফুলে অযথা লজ্জা পাই
গম্ভীর কাঁচে বসে, নিজেকেও পর ভাবি।
এসব কি খেলা হবে কোনোদিনও ? অভ্যাসে
এদেরও কি ফেলে যাবো খালপারে, কলধারে ?
নিভৃত বকুলগুলো, জারুলের অগোছালো
গোলাপি পশম ছেলে পশম গল্প হয়ে
মেলায় বেড়াতে আসে , এমনি শ্রাবন মাসে
হঠাৎ ফস্কে গেলে তোমার হাতের সুতো
আমিও বোকার মতো , আমিও ল্যাবার মতো
আকাশে দাঁড়িয়ে থাকি, জিলিপি দুঃখ ভুলে।
বুঝতে পারি না আমি একলা মেলার মাঠে
খেলায় ক্লান্ত হব, যতদিন ঘুম আমাকে
এই মাঠে, এই কাঁচে স্বতন্ত্র ছেড়ে রাখে?
নয়তো অন্যথায় বিশাল কান্নাকাটি,
বায়নাবাটির জোরে অযাচিত আবদারে,
যে করে ফিরিয়ে নেবো জারুলগল্পগুলি,
নদীর গোলাপি ভেড়া, পরীদের অঙ্গুলি ?
কবি জয়দেব
তোমার কাছে সমাজতন্ত্র মরণ কিংবা শ্যামসুন্দর।
আমার কাছে নিছক শব্দ, পুরোনো বুট পালিশ।
ছিয়াশি সাল, ইশতেহারের রূপক ঘেঁটে জন্মান্তর
খুঁজছি এবং খোঁজা মানেই ইতিহাসের সালিশ !
সুরঙ্গমার রঙ্গ থাকুক, যুদ্ধ কিংবা সমাজশরিক,
বেকার বকচে' লুম্পেন আর বিবেকপরশমনি,
মিথ্যে এবং মিথ্যে কেবল, দর্শনাতীত আড়ম্বরে
তোমার কথার ঠুনকো মডেল গড়তেছি আনহোনি
নকল এসব নকলনবিস, মধ্যমেধা এলিট-রতন;
পণ্য মানে মলবিহীনা রাস্তা এবং নারী।
পূর্বপুরুষ, ছিয়াশি সাল রূপক ঘেঁটে ইশতেহারে
যা পাচ্ছি তা এহিস্টোরিক,গুছিয়ে সংসারী।
তাহার পরে কনভোকেশন, সান্ত্বনাশ্বাস, কুলোর বাতাস,
বিদেয় হলো মনভিখিরি, কর্পোরেট ও হলো।
তবুও তোমার সামনে পড়ে এ ভেকধারী শব্দ খোয়ায় --
পূর্বপুরুষ, লক্ষ উপলক্ষ্য দুয়ার খোলো।
এ জনমেজয় ধ্বংসগুষ্টি তুষ্টি করছে যজ্ঞ ধোঁয়ায় --
তোমার মতো লিখবো যেদিন সেদিন ভালো বোলো।
সময়কে হাত দেখাও
হৃদয়হীনের শহরে এবার সময়কে হাত দেখাও, বল থামো।
এই যে সময় ছ্যাবলার মত কেমন দুহাত ভরিয়ে দিচ্ছে , দ্যাখো।
এবং যাদের বাড়ি ফেরবার তাড়া
তাহাদের মতো দ্রুতগতি পায় সন্ধ্যের সিঁড়ি ভাঙো।
হৃদয়হীনের শহরে এবার সময়কে হাত দেখাও। বলো থামো।
কুর্নিশ করে চলেছে নীলাম্বরী
যমুনার মত আর এক যমুনা কব্জিতে হাতঘড়ি
পায়ের তলায় পায়রা ইহারা নোংরা ডানার পরী
পায়রা এবং ইঁদুরের মতো প্লেগের পূর্বসূরি
আঢাকা ড্রেনের শহরে আজকে তুচ্ছ করহ তাহাদের বদনামও।
এই যে সময় বিকচপ্রান্ত ধোঁয়াশার ডানা মেলে বসে আছে দ্যাখো।
এবং যাদের দারুন তীব্র রাত্রি
সারারাত ধরে চোখে জল দেয় -- মুখস্ত করে হাতড়ে
চাকরির পড়া -- এবং যাহারা দারুণ বাধ্য ছাত্রী
ভিড় ট্রেনে বুকে জড়িয়ে চলেছে কবিরের মহা গাঁঠরি
তাদের মতন মন্থর হও। এস্কালেটরে আলগোছে পেতে রাখো
দুর্মদ কিছু দুঃখ। এবং কেমন নামছে শূন্যতা বসে দেখো
এবং আকাশে মিনারে মিনারে মেঘেদের এই জঘন্য পাগলামো--
হৃদয়হীনের শহরে এবার সময়কে হাত দেখিয়ে ঠেকাও , থামো।
মীর -- অভিশাপের গৌরচন্দ্রিকা
পরবর্তী কবিতায় ফিরে ফিরে আসেন অনেক মুর্শিদ -- যাদের পদতলে শব্দরা বহুদিন চুপ করে বসে আছে। তাঁদের খুঁজে নিতে নিজামুদ্দিনের পথে ঘাটে প্রায়ই ঘুরে বেড়াই দিওয়ানার মত। ইচ্ছে করে আজীবন বসে থাকি খুসরো-গালিবের কবরের ওপর -- যেখানে রাজার ডাকঘর। একদিন জানতে পারি আরেকটা ডাকঘর-ও ছিল রাজার। আজ সেই মীর-তাকি-মীরের বুকের ওপর দিয়ে রেলগাড়ি চলছে। এই যে হতভাগ্য রেলগাড়ি -- যাকে এই সরলরেখা মাড়িয়ে চলতে হচ্ছে প্রতিদিন প্রতিরাত -- যার কয়লাশ্রমিক হবার কল্পনা নেই -- যে কখনো অবসরেও খুঁজে দেখেনি গোলাপের জেলখানা-- নোঙর হারানোই তার একমাত্র অমোঘ নিয়তি। যেদিন প্রথম কোনো কবির কবরের ওপর দিয়ে প্রগতির রাজপথ, রেলপথ তৈরী হয়েছিল-- সেইদিনের বিস্মৃত অভিশাপই তো প্রাত্যহিক বয়ে চলেছি। যদিও আমি নিশ্চিত-- প্রগতির স্বার্থে হয়তো সেটাই আশুপ্রয়োজন। আমরাই দুর্ভাগা-- রাজার চিঠির অক্ষর চোখে কেবল সাদা হয়ে আসে।
মীর (১)
শব্দ মানে শব্দ যারা জানতো অন্ধ তাদের অর্থ এনে দেয়
আর বাকি সব দীন, খোয়াবে ক্লান্ত
আদ্যোপান্ত জ্যান্ত জানালায়
শহর মানে রাজধানী বা পান্থ পরিব্রাজন এমন সীমানায়
যেই কুয়োতে অন্ধকারও শান্ত
জল অথবা নোংরা যমুনায়
আর এক শহর-- শহর কিংবা পান্থ রাজধানীতে ভিক্ষে করে খায়
এমন তো নয় এই কথা যে জানতো তার বাড়িতে রাত্রি গতিময়
এখানে সব হাসীন- জামীল সন্ত
যাহার পাশে খুঁড়েছে আশ্রয়
তাহার কাছে, সময়, তুমি মন্থর আমায় খালি সকলে ঠোকরায়
এই শহরে সবার তিনি অন্তর
কিন্তু তাহার অন্তরে কে যায়?
যে যায় তাহার সড়ক অফুরন্ত, আমায় শুধু তরাসে ঠোকরায়
শব্দ-- যারা শব্দ মানে জানতো -- এ মেহফিলে তাদের পাহারায়
জিনপরীরা ফুল ফোটাতে ব্যস্ত,
কবরখানায় রাজার দেখা পায়
এমন আছেন ক’জন পয়মন্ত? যে পায়, কেবল তাদের জানালায়
বিন-বুলায়া শব্দেরা সব ন্যস্ত।
বিস্মরণের গভীরে নিদ্রায়
আর যা বাকি সময় অফুরন্ত দারুন লোভে সকল চুষে খায়।
শব্দ-- যারা শব্দে পয়মন্ত -- সবখোয়ানো ফকিরি দরজায়
শব্দ, শুধু শব্দে অবিশ্রান্ত
ডুবসাঁতারে রোজ পেরিয়ে যায়
অর্থবহ দারুন অতলান্ত, মজলিশে বা তরঙ্গ-তরজায়,
কিংবা একা চমকে ওঠে ত্রস্ত ,
যখন দেখে ভিক্ষেসীমানায়,
মীরের কবর মাড়িয়ে সূর্যাস্ত অন্ধকারের রেলগাড়িতে যায়।
মীর (২)
ঘুমিয়ে থেকেছে প্রলাপের
মতো কবরে, এবং গোলাপের
মতো উন্মাদ ছিল সাধে কি?
তাহাকে বিস্মৃতিতেও বাঁধে কি ?
তার জিন্দেগী-- সে তো বুদ্বুদ ,
তাই মরবার পরে ঔষুধ
নিয়ে মেসিয়া গিয়েছে দরজায়
গিয়ে দেখেছে সেখানে ঘর নাই।
তায় সংবাদ পেল রেলেরা
এবং ভ্রান্তভ্রমরা ছেলেরা
তবুও অমন গভীরে গর্তে
ফেলিবে কে জাল অমরাবর্তে ?
যদিবা বিস্মৃতি তাকে ধরিত
তাহলে জাল ফেলা তবু চলিত
কিন্তু যেখানে প্রেতেরা শান্ত
তাদের কি সাহসে বেঁধে আনতো ?
অ'তেব বসিয়া রইলো পরীরা
এবং দুঃখের কিঙ্করীরা
মীরের কবরে; পাথরে প্রলাপে
মাটির কাফাস ভরিলো গোলাপে
এবং সংবাদ পেল রেলেরা
এবং ভ্রান্তভ্রমরা ছেলেরা--
কিন্তু যেখানে দুঃখ শান্ত,
তাহাকে কি সাহসে বেঁধে আনতো ?
বন্ধু তুমি কি সে কথা জানতে
সেদিন নির্জন নদীপ্রান্তে
আমিও রেলগাড়ি অভিশপ্ত ?
এখন বাকি আছে শুধু এক কাজ
আমি নিজেকে ভাবব সে জাহাজ
যার নোঙর-হারানো রপ্ত !
নের্ভালের আত্মহত্যা
ভূমিকা : প্যারিস শহর আবছায়া দেখেছে। অন্ধকারের কবি বোদলেয়ার বলেন, সবচেয়ে অন্ধকার গলি বেছে নিয়ে নিজের আত্মাকে সেখানে ছেড়ে এসেছিল কবি। অতএব এ নোংরা লণ্ঠন গলি অন্ধকার চেনে। থিবো, ফাউস্ট তখন অতীত। সমসাময়িক বন্ধুরা হয় পরিত্যাগে নয় অভাবে ধুঁকছেন। পরবর্তীরা তখনও আগামীর গহ্বরে। বাকি থাকে কেবল আত্মরতি। পানাহ্লাদ। এবং ছন্দপ্রলাপ। কিংবা সুইসাইড নোট।
আজকে সাদাকালোর রাত
নাইবা জেগে থাকলে আজ
পানশালাতে ধূসর হোক
মৃত্যুসাথে জমজমাট
আজকে সাদাকালোর রাত
আজকে সাদাকালোর রাত
গ্যেটেও নাকি বলেছেন
কুকুর পোষা ভালো নয়
এখানে জমকালো নয়
বিষন্নতার বীঠভেন
গ্যেটে পাগল ছিলেন না
গ্যেটে পাগল ছিলেন না
নীল রিবনে চিংড়িমাছ
প্যারিস চ'রে বেড়াচ্ছে
সমুদ্র যার পরম প্রেম
আমার প্রিয় সে গম্ভীর
নীল রিবনে চিংড়ি মাছ
প্যারিস চরে বেড়াচ্ছে
ফাউস্ট ঝড়ে তলিয়ে যায়
তন্নিবিষ্ট দস্যুকায়
আমার ভিতর যে শয়তান
একলা বুনোট আঁধার গান
তন্নিবিষ্ট দস্যুকায়
ফাউস্ট ঝড়ে তলিয়ে যায়
সত্ত্বা আমার মূর্ত প্রেত
দারিদ্রঘাস চিবিয়ে খায়
আমার পকেট শস্যক্ষেত
পানকুঠুরির জানলাঘর
মৃত্যুসাথে স্বয়ম্বর
সবাই বলে মূর্ত প্রেত
পানশালাতে জমজমাট
আজকে সাদাকালোর রাত
টুপিও নাকি খুলছে না
দেহ ও নাকি ঝুলছে না
এমন বিষম বিসংবাদ
আজকে সাদাকালোর রাত
আজকে সাদাকালোর রাত
( বেড়ালেরা প্রলেতারিয়েত- 2019)