এই মাসের কবি : তথাগত দত্ত
তথাগত দত্ত, জন্ম ১৯৮৯ সালে। তরুণ কবি, তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য পত্র পত্রিকায়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশ, কৃত্তিবাস, কবি সম্মেলন, বৃষ্টিদিন ইত্যাদি। ২০১৯ সালে পেয়েছেন সমিধ কবিতা সম্মাননা। যাপনচিত্র প্রকাশনা সংস্থা দ্বারা প্রকাশিত তথাগত দত্তর কবিতার প্রথম বই : সূর্যাস্ত থেকে তেত্রিশ কিলোমিটার দূরে। তথাগত’র সাথে যোগাযোগ করতে হলে মেল করুন: poetryandtathagata@yahoo.com
কবিতা
বাতাস, আলো অথবা অন্য কোনও নাম দেওয়া যেতে পারে
আমার জানলা দিয়ে কখনও কোনও আকাশ
এসে ঢোকেনি আমার ঘরে
বাতাস আর আলো মাঝে মাঝে আসে ঠিকই
কিন্তু এতে আমার হয় না
জানলার গরাদ দেখে আমার মন কিছুতেই খুশি হতে পারেনি কোনওদিন
আমি দেখতে চেয়েছি দিগন্তবিস্তৃত পাটখেতের ভিতর
কীভাবে সূর্যাস্ত হয়!
কীভাবে জোয়ার আর ভাটা খেলা করে যায় রোজ!
তারপর একদিন আমি ঘরের ভিতর থেকে বাইরে বের হয়ে এলাম
বাইরে থেকে দেখলাম ঘরটাকে জানলার গরাদের মধ্যে দিয়ে...
কী যেন একটা জিনিস! আমি হাত রাখলাম সেটার উপর
আশ্চর্য! দেখতে পাচ্ছি সবই কিন্তু অনুভূতি নেই...
স্কচ ও দেবযানী
কিছুটা পুড়ে যাওয়া, আর কিছুটা
ক্ষয়প্রাপ্ত শিলার মতো টুকরো টুকরো বরফের কিউব...
চারদিকে যে সব আলো জ্বলে আছে
সেগুলোকে নিভিয়ে দিলেই বোঝা যাবে
দেবযানী আসলে সম্পূর্ণ একা...
এতদিন যে অপেক্ষা করত, আজ সে-ই উপেক্ষা করে যায়
আমি দেবযানীকে দেখেছি কাচপাত্র হাতে --- স্কচ ও দেবযানী!
তারপর আরেকটু অন্ধকার মিশে গেলে
রাত আরও গাঢ় হয়ে ওঠে
দেবযানী, তুমি হেঁটে যাও রোজ
একা...
অন্ধকারের কাঙাল
লজ্জা ঢাকতে তুমি অন্ধকারের সাহায্য নিলে
কিন্তু তাতে ঢেকে গেল তোমার রূপ...
আমার তো লজ্জাবোধ ছিল না কোনওদিন
রূপও পাইনি কখনও
তবু আমিও তো অন্ধকারের কাঙাল...
আমার শিরার ভিতর অন্ধকারের স্রোত বয়ে চলে রোজ
টানা তিনদিন উপবাস করার পর
উপহাস করেছি নিজেকে...
তারপর তো দৃষ্টি ঢেকে গেল
তোমার দুচোখে এমন বৃষ্টিদিন
আমাকে জন্মান্তরের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়...
আমি স্মৃতি হারাই, তুমি চলে যাও অন্য বনাঞ্চলে
তোমার ক্লান্ত শরীর, দু চোখের তলায় কালি
তবু তোমার চোখে রাখি আমার চোখ
একদিন তোমার চোখের কালি তোমার দু –চোখে কালো কাজল
হয়ে যাবে,
দেখো!
নীল
আঘাতে আঘাতে রোজ রাতে নীল হয়ে উঠি...
কয়েকজন আমাকে বলল --- তুমি বরং সমুদ্র দেখে এসো, শান্তি পাবে।
আমি কখনও সমুদ্র দেখিনি
সমুদ্র দেখা তো দূরের কথা আমি কখনও ঢেউয়ের শব্দও শুনিনি
তবে
ঢেউয়ের গল্প শুনেছি
সমুদ্র যে ঠিক কোন দিকে তাও জানি না
তাই একটা মানচিত্র নিয়ে বের হয়ে পড়লাম
হাঁটতে হাঁটতে একসময় এসে পৌঁছলাম সমুদ্রের ধারে
দেখলাম ঢেউয়ের পর ঢেউ
ঢেউয়ের আঘাতে সমুদ্রের জল গাঢ় নীল হয়ে আছে
তাহলে কীই বা পেলাম সমুদ্র দেখতে এসে! আঘাত ছাড়া?
আমি তাই ফিরে যেতে চাই অন্ধকারে, অন্তত অন্ধকারের কাছাকাছি
পকেট থেকে মানচিত্রটি বের করি
সমুদ্রের থেকে ঠিক কত দূরে অন্ধকার, মানচিত্র কী সেকথা আমাকে বলে দেবে না?
ইতিহাস
নদীর স্রোতের পাশে আমি ইতিহাস খুঁজেছি
দেখেছি বহু শতাব্দী পুরোনো ভাঙাচোরা মন্দিরের গায়ে
জমে আছে জারুল গাছের ছায়া...
আমি এই ছায়ার ভিতর থেকে কুড়িয়ে নিয়েছি ধুলো
তারপর উড়িয়ে দিয়েছি...
আর তখনই আমার কানে এসেছে মহামন্ত্রবীজ
"ওম্----মণি----পদ্মে----হুম্"
আমি ছোটো বড়ো পাথরের উপর পা ফেলে এগিয়ে গিয়েছি
পরিত্যক্ত স্থাপত্যের দিকে...
জরাজীর্ণ স্থাপত্যের সামনে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছি ---
তথাগতশূন্য প্রাচীন
প্যাগোডা...
নদীটা এখানে আরও প্রশস্ত বলে আমি জলবিদ্যা শিখতে পারিনি আজও
শিখতে পারিনি কৃষিকাজ
তাই ব্যক্তিগত ইতিহাস ধুলো হতে থাকে...
হয়তো বা মুছে যাব আমি, মুছে যাবে জলছবি, মুছে যাবে সূর্যমাখা রং...
ছোটো একটা ডিঙি নৌকোতে উঠে বসি
ভাটার স্রোতে নৌকো এগোতে থাকে
তার ভিতর থেকে উঠে আসে ভাটিয়ালি সুর
তারপর আবার ডুবে যায় জলের গভীরে
এখন মাধ্যাকর্ষণের টানে সন্ধ্যা নেমে আসছে জলের উপর...
ধুলো
নীল ছবি চলে আসার পর
হলুদ মলাট আর খুলে দেখে না কেউ
ধুলো জমতে থাকে...
আমার শৈশব বৃষ্টিতে ধুয়ে ম্লান
আবার আমার শৈশব বৃষ্টিতে ধুয়ে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে...
আমি আছি, আমি থাকব চিরকাল
এ কথা শুনে লোকে বিদ্রুপ করে, উপহাস করে খুব।
আজ তোমাদের স্মৃতিতে রয়েছি
কাল থাকব বিস্মৃতিতে...
যে জাহাজ ছেড়েছে বন্দর
শুধু এই হেঁটে যাওয়া
অন্তের পথে না অনন্তের পথে তা তো জানা নেই
তাই কিছু না জেনেই আমি ঘুরেছি অনেক...
বেড়া দিয়ে আমার বেড়ানো কেউ আটকাতে পারবে না
ভ্রমণেই আমি কাটিয়েছি ভ্রম...
ভিড় আর যানজটে কোনও জান ছিল না বলে শহর ছেড়েছি
ফেরিঘাটে সন্ধ্যা নেমে আসে
সব কোলাহল ডুবে যায় জলে; ডুবে যায় মাঝিমাল্লার ক্লান্ত মল্লার...
যে জাহাজ ছেড়েছে বন্দর --- আমি তার কথা ভুলে
পার হয়ে যাই গ্রামের পর গ্রাম
হেঁটে যাই সেইদিকে
যেখানে অন্ত আর অনন্ত মিশে এক হয়ে আছে...
কথা
গোলাপের গন্ধ নাকে এলে আমি বলে দিতে পারি
লাল নাকি ও কোনও হলুদ গোলাপ...
উড়ে যাওয়া পাখির ডানার শব্দ শুনে আমি বলে দিতে পারি
ও পাখি কোনওদিন
সমুদ্রে ভেসে থাকা কোনও অজানা দ্বীপের সন্ধান পেয়েছিল কিনা...
বিকেলের ব্যালকনিতে বসে আছি
একটুকরো মেঘে আটকে রয়েছে রোদ
সে মেঘও সরে গেল মৃদু বাতাসে
আর তখনই ওই রোদটুকু এসে পড়ল তোমার গালে
তুমি বলছিলে কথা, জমে থাকা কথা অনেক
আর আমি ভাবছিলাম এই বিকেল আর তোমার এই কথারা যেন
শেষ না হয় কোনওদিন
তোমার ঠোঁট ছুঁয়ে আসা শব্দগুলো আমার ভালো লাগছিল খুব
তবু তুমি থামলে
আমার চোখে চোখ রেখে বসে থাকলে অনেকক্ষণ
এবার তোমার ঠোঁট ছুঁয়ে আসা নীরবতা আমাকে মুগ্ধ করে গেল...
কবিতা
একদিন আমারও মৃত্যু হবে
এই সত্যটা জেনে যাওয়ার পর থেকে
গর্বে
মাটিতে আর পা পড়ে না আমার...
তাই জীবনটাকে ছুঁড়ে দিয়েছি
শ্মশানে, জ্বলন্ত চিতার উপর,
আবার কখনও হিংস্র চিতার সামনে
বনে বনে ঘুরেছি অনেক
তবু মৃত্যু এল কই?
তাই আমি চিরকাল অমৃত থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছি
মোহিনীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে যাইনি কোনওদিন
যদি ভালোবেসে সে আমাকে অমৃত পান করতে বলে!
তাহলে তার কথা আমি ফেলতে পারব না কিছুতেই...
আমি কবিতা লিখেছি , কবিতা আমি লিখে যাচ্ছি রোজ
একের পর
এক...
একদিন আমি হেঁটে যাব দীর্ঘ কবিতায়
সেখানেই আমার সঙ্গে যেন মৃত্যুর দেখা হয়ে যায়
আমার মৃত্যু যখন, সে তো কবিতা ছাড়া অন্য কিছু নয়...
ঋণ
স্নানঘরে তুমি গান করো যখন, পাশের ফ্ল্যাটে ভেসে আসে তার সুর
আমি শুনি...
কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করি, তবে পারি না সবসময়...
সেদিন তোমার স্নানের সময় ভেসে এল যে গান, তার সঙ্গে
সাবানের সুগন্ধ মিশে ছিল...
মার্গো সাবান!
সংগীতের শিক্ষা আমার ছিল না কোনও দিনও
শুধু তোমার নগ্ন শরীর থেকে ভেসে আসা মার্গো সাবানের গন্ধ
আর দু-চার কলি
গান
আমি তাকেই মার্গসংগীত বলে জানি...
কতদিন হল তুমি ছেড়েছ ও ফ্ল্যাট , আমিও ছেড়েছি তোমার শ্রোতার আসন
তবু আমার অন্তরে এখনও সে অন্তরা বেজে ওঠে মাঝে মাঝে
মাঝে মাঝে ঋণী মনে হয়.... মাত্র দু-চার কলি গান... আমাকে শান্তি দিয়েছিল
জানি, এ ঋণের সুদ হবে না কোনওদিন
কোনওদিন এ ঋণ শোধও হওয়ার নয়…