এই মাসের কবি : সুরজিৎ পোদ্দার
১৯৮৯ সালের ১৬ই অক্টোবর উত্তর কলকাতার বাগবাজারে জন্ম। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক, বর্তমানে একটি বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত। স্কুল কলেজের পত্রিকায় মূলত লেখালেখির শুরু। ২০১৫ সাল থেকে বন্ধুদের সাথে আনুষঙ্গিক পত্রিকার সম্পাদনা শুরু, সাথে বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন ও পত্রিকায় কবিতা ও কবিতা বিষয়ক আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে। ২০২০ সালে যাপনচিত্র প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মণিকরণ'।
কবিতা
বৈরাগ্যের বিপরীতে
রক্তশূন্য এই মাঠে, উড়ছে শীতলতা, বৈরাগ্যের বিপরীতে
আমাদের বাকপথে শুষ্কতা বন্ধ করেছে যাবতীয় যোগাযোগ
আমরা ক্রমশ কক্ষপথ থেকে কক্ষপথ বদলাতে বদলাতে
আদিগন্ত আদিম শূন্যতার মাঝে মৃতপ্রায় নদীর মতো,তবু মৃত নয়
বিন্দু বিন্দু আগুন বৃক্ষের মতো, তবু ছায়াশূন্য এই রাজপথ
রাজা কোথায়, কোথায় তার কাপড়, কোথায় তার মৃত ঘোড়ার দেশ
যুগান্তের যুদ্ধের পরেও কিভাবে অক্লান্ত এই সভ্যতা, কোথা থেকে আসে অমৃতের বানী
কোথা থেকে আসে অমৃতের পানি
আদিগন্ত এক রক্তশূন্য মাঠ, শীতল হাওয়া মুছে দিচ্ছে আমাদের যাত্রাপথ, আমাদের ইতিহাস
ধূসর
ধূসর লাল - ধূসর সবুজ - ধূসর কমলা - ধূসর নীল সাদা
ধূসর ধুয়ে ধুয়ে পড়ে চোখের তল বরাবর
এই যে গমরঙা দুপুর -
এই যে রোদের গন্ধমাখা সোয়েটার - না ধোয়া চুলের ঘ্রাণ
অফুরান বয়ে চলা
মুহূর্তে ছিঁড়ে যায় এই মায়া
অচেতন থেকে যেন জেগে ওঠে সমগ্র
পৃথিবীর ধূসরতা।
গরম চায়ের ভাঁড়ে ফু দিতে দিতে
ব্যারিকেড হয় ছোটো ছোটো মুহূর্ত ।
অণু - পরমাণু স্থানু হয়।
কি নিবিড় এই বিপ্লবের বয়ে চলা
অস্ফুটে হাত মুঠো করে তুলে ধরি
নিরন্নের মুখের সীমানা বরাবর
সে পথে মাইন ছড়ানো, ছড়ানো হেরোইন আর শেষ
সেই শেষের কাছাকাছি ধূসর রাঙায় কারা যেন
কারা যেন আজও সাইকেল আর বল্লমে বয়ে চলে
কারা যেন হাত থেকে কেড়ে নেয় মোবাইল
চোখে থুথু ছেটায় আর পাথর ছোড়ে অবিরত ।
গুহাবাসী আদিম মানুষেরা এইক্ষণেই পিদিম জ্বালাতো নবাগত সন্ধ্যাকে বরণ করে নিতে
আলতামিরায় - অজন্তায় - ইলোরায়
এই আলোছায়ায় মাতিশ লাল ভাসিয়ে নিত
বেঁচে থাকার তীব্রতায় ।
দুদণ্ড নিঃশ্বাস ভরে নেই বুকে
আগুনের কাছাকাছি খুঁজে বেড়াই তাদের
কি এক লগ্নতায়
বয়ে চলে মাছরাঙা - কাক - শালিক
কচুরিপানার ভেলাটুকু যান
অস্ফুটে প্রশ্ন করি তাদের -
" সারাদিন কি কর তুমি
ডিঙি সেজে শুয়ে থাকো ঘাটে
দোলা খাও পৃথিবীর দোলা "
জেগে উঠবোই
অন্ধকার, নর্দমা জল ঠেলে জন্মকালে বুঝিনি প্রিয়তমা
এ জীবন, শুধু অরন্য রোদনে বয়ে যাবে সামান্য তরলের ছোঁয়ায়
কীসের শব্দে সন্ধ্যে ঘনায়, চরাচর জুড়ে আরতির ঘন্টা
আর্তনাদের মতো বুড়ি নদী পার হয়ে চলে গেছে কুয়াশার সাথে
সেই পথে একটা বাদুড় আসে, ঢেকে দেয় চাঁদের আলোক রেণু
এক গভীর অসুখ সেই আদিমকাল থেকে বয়ে বয়ে
এগিয়ে চলেছে মানুষ। এগিয়ে চলেছে...
মৃত্যুর দিকে? কবরের দিকে? চিতার চিলেকোঠায়?
আমি এক মৃত প্রেতাত্মা অন্ধকার বিশ্বাস করতে করতে
নির্লিপ্ত তথাগত সাজলাম, এ কার মগজধোলাই
পেটের ভিতর চোলাই বাষ্প হয়, লাশ পোড়ায় পুলিশ,
আব্বুলিশ বলতে বলতে মরে যায় কর্ণ, কর্মকর্তা বধিরশিরোমণি
শুধু পাখির চোখ দেখে দেখে অর্জুন হতে চাওয়া এই পরাবাস্তবে
পাখির গতিপথ থেকে সুর হলো কই?
সামান্য মাতাল অপবাদ ঘুচে গেলে দেখো একদিন জেগে উঠবোই
নিশীথ মৃতের দেশে
আমার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে এক অনির্বচনীয় প্রাণ
তার নরম চুল গুলো এখন স্বাধীন... যেভাবে ঝরে পড়ে পাতা
রাত্রি ক্রমশ গাঢ় হলে ক্লান্ত হয় হৃদয়
কী গভীর উপশম নিয়ে আসে আমাদের পথে
রাত্রি রাত্রি রাত্রি, কে হও তুমি আমার?
চিরকালীন পিতার মতো, শিশুর ত্বকের মতো
প্রেমিকার ঠৌঁটের মতো পিচ্ছিল তবু গভীর
একটা ঘোড়া দৌড়ে বেড়ায় সবুজ ঘাসের দেশে
অন্ধকার আর চাঁদের বিপ্লব। চিরকালীন আশ্রয়-
আশ্চর্য ঘুম জড়িয়ে ধরে লক্ষ্মীপেঁচার বিস্তৃত ডানায়...
তবু কেন শব্দ রক্ত হয়ে ঝরে পড়ে, মৃত মানুষের রাজধানীতে
তবু কেন ঝরে পড়ে গুলি, বৃষ্টির পথে পথে
তবু, তবু কেন নুইয়ে পড়ে শরীর ঘাসের অভ্যেসে
কেন জড়িয়ে ধরে আগুন ধ্বংসের রাজবেশে
একটা অনির্বচনীয় প্রাণ এখনও আমার কোলে - নিষ্প্রাণ ঈশ্বর কণা যেন
যেন কোনো মৃত নগরীর রাজা। শান্ত, অভিব্যক্তি বিহীন
মা
সুদীর্ঘ সময়ের ঐ পারে পড়ে আছে
আমাদের সহবাস, আপাতত অসহায়
আপাতত হিংস্র। যে প্রাচীন দুপুর গুলোয়
মায়ের স্মৃতি থেকে চুঁইয়ে পড়েছে অচেনা পেয়াড়া গাছ,
সকালের উনুনের ধোঁয়া, আধশোয়া ঐকিক নিয়ম
তারা আজ আমার স্মৃতি, আমার শব্দ।
কী অন্ধবিশ্বাসে মলিন শাড়ি আর অচেনা ছেলের প্রেম হয়েছিল
সে যেন মহাভারতেরও আগে, রামচন্দ্রের স্বেচ্ছামৃত্যুকাল
সিঁদুরের টিপ ঘসে ঘসে সারা কপাল
লাল
একটা বিড়াল, পোষা নয়, ছাপোষা শুধু মাছ খাবে বলে
আমাদের রান্না ঘরের ভিতর, ভীষণ শব্দে ভেঙে যায় বাসনের স্তূপ
চুপ!
ঝুপ করে জলে নামে পানকৌড়ি, মাছরাঙা
একটা সিগারেট একা একা পুড়ে যায় বিকালের রোদে
আমার মা, শাড়ীতে আঁশটে গন্ধ, মাছের নয়
মায়ার
এখনও জেগে থাকে সারারাত, মুদ্দাফরাশ যেন
বয়ে যায় নিজের স্বপ্নের লাশ
মায়াবিস্তারের পথে
মায়াবিস্তারের পথে
কতটুকু শান্তি খুঁজে পেলে?
দাঁড়াও আর একটিবার
অন্তরালে ক্লান্ত হলো বেলা
মায়াবিস্তারের পথে
কত শত রক্ত ঝরছে দেখো-
আর কতটুকু পথ
শান্তি খুঁজে পেলে? পেলে বলো?
ওরা আসে
রোজ যখন সূর্য ডুবে আসে
তখনই ওরা আসে
আমি আসন্ন মৃত্যুর মতো - অভিজাত
স্থবির । তবু চঞ্চল অন্তরঙ্গ, কত শত
আকাশকুসুম
আর চোখ জুড়ে ঘুম
ঠিক তখনই ওরা আসে
দৃশ্যপট ভাঙে গড়ে আর
ভেঙে পড়ে বালির বাঁধ
নাবালিকা প্রেমিকা আমার
ছুঁয়ে থাকে চিবুক
কেউ কোনো কথা বলে না
ইশারায় ইশারায় ছড়িয়ে পড়ে খবর
ওরা এসে গেছে মা গো
আমার ক্লান্তি আর জড়তা
আমাকে ঈশ্বরের মতো
অদৃশ্য করে রাখে।
তবে ঈশ্বরও কি ক্লান্ত,
ঈশ্বরও কি জড়?
আর কতদিন, আর কতদিন
স্বপ্ন ভেঙে সূ্ঁচ ফুঁটবে বল...
ফুল
ফু
ট
বে
না....
ক্ষয়িষ্ণু দিন
ক্ষয়িষ্ণু দিন।
এক এক করে শালিকেরা বাড়ি ফিরছে
শালিকেরা ফিরছে, একা। একা।
আকাশের নীচে
আমাদের আলোর টেবিল
সারি সারি ভেজা দেশলাই - কবিতার ভিড়
সারি সারি শালিকের হলুদ চোখ, হলুদ পা
পৃথিবীতে নরমের ঘর। আলো নিভে আসে
তাদের ভিতর
তাদের ভিতর ভাঙে ঘুম, ভাঙে আলোর দোকান
শিশুর নরম এসে ছুঁয়ে থাকে আমাদের স্বর
শালিকের দল ভেঙে গেলে, ভেঙে যায় আমাদের ঘর
একটা সাদা বিড়াল
একটা সাদা বিড়াল, আমাদের কার্নিশ পেরিয়ে
পাশের ছাদ পেরিয়ে, আকাশ পেরিয়ে
থাবা বসাচ্ছে জানলার কাঁচে, নির্বিকার চেয়ে থাকি...
ছুঁয়ে দেখি তার মৃত্যুপথ, বাঁকা চাঁদ
হাহুতাশ করে শীত সমস্ত শরীরে
বাইরে আগুন জ্বলছে আজ।
শপথের আগুন? মৃত্যুর আগুন?
আশ্রয়ের আগুন? নিরাশ্রয়ের ?
রাম বলতে বলতে কখন মরা হয়ে যায়,
এ সভ্যতা রাখতে পারে না আর
মৃত কবিদের কলমের ভার
অবশেষে জানলা ভাঙে, ঘোর কাটে না আর
নির্বিকার জড়িয়ে ধরে সেই আঁচড়
লাল আলতার ছোপ ছোপ পায়ের ছাপ
খোপ কেটে যায় এই বুকে
সমস্ত ব্যর্থতা অদৃশ্য করে উড়ে যায় উড়ালপুল
মাছি বসে থাকে, পাখি আসে না আর
আমার নৈসর্গিক সকালে...
এ সময় প্রেম হয়? পূজা হয়? কবিতা হয়?
স্লোগানে নৈঃশব্দ নামে, থেমে যায় আলো।
তুমি এখনও অপেক্ষা করো?
প্রেমের? পূজার? কবিতার? বিপ্লবের?
ভিড়ের হৃদয় পরিবর্তন হবে?
প্রশ্ন থেমে যায়, জ্ঞান নিঃসঙ্গ
ধোঁয়াচ্ছন্ন আকাশ। নির্বিকার।
জল
আমি নিদ্রাহীন,
কেবল একফোঁটা জলের জন্য
আসমুদ্র-আকাশ ঘুরে এসে
নিশ্চল তোমার দরজায়
সবটুকু মেঘ গিলে গিলে আজ
তুমি পুঞ্জীভূত জলরাশি যেন
যেন অনন্ত দৌড় এই স্থির পলকটুকু
গিলে নিতে পার
নিতে পার সমস্ত প্রতিবিম্বকে অপার করে...
বহুদিনের নানা বয়ে চলার পর
শুধু নিজের পা দুটিকে নিজের বলে যখন
ফিরে এলাম
এলাম তো তোমারই কাছে
টলটলে-স্নিগ্ধ-নীল তোমার দরজায়
পেশি-ধমনী-হাড় বেয়ে যে হাজার রমণীয় ক্লান্তি
সবই যেন গল্পের মতো
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শব্দের মতো - অক্ষরের মতো
এক অমোঘ মিলের অপেক্ষায়
অপেক্ষায় নিদ্রাহীন এ আবেশ যেন
আদতে এক নিদ্রা'র মতো
সুদীর্ঘ সময়ের সেই চিরকালীন পিতার মতো
যার নিশ্চুপ আলিঙ্গন
মৃত্যুসম শান্তির - সুস্থির - অন্তহীন যাত্রাপথ এক