এই মাসের কবি : শৌভিক পাল
আলাপ পর্ব
জন্ম মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে। কাজের সূত্রে হাওড়ার সাঁকরাইলে বসবাস। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনার পর উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক বাংলা কবিতার গবেষক। 'কবিতা আশ্রম', 'অপরজন', 'তবু একলব্য', 'এবং প্রান্তিক' ইত্যাদি মাসিক ও গবেষণামূলক পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা রচনা ও আধুনিক বাংলা কবিতা বিষয়ে গবেষণা--এই দু'য়ের মিলিত পথের একজন উন্মুখ যাত্রী। শৌভিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে মেল করুন shouvikpal143@gmail.com এই ঠিকানায়।
কবিতা
দিক
সেদিকেই যাও
যেদিকে দাঁড়িয়ে হিমেল বৃক্ষ নীরব প্রসন্নতায়,
তোমার জন্য দু’হাত বাড়িয়ে মেঘের সম্ভাষণ
সন্ধ্যাবেলার অতন্দ্র দীঘি তারকার দর্পণ
যেদিকে একলা
প্রতিটি ছন্দে মিশিয়েছ তুমি ঘনিষ্ঠ তাপ
তোমার জন্য অপেক্ষমাণ অভিজ্ঞ ঘাস বন্ধু-পাহাড়ে
সেদিকে এক পুরাতন বুড়ি শরীর পুড়িয়ে অপেক্ষা করে
কবিতায় কোনো অব্যর্থ স্বাদ পাবে বলে।
তোমার পৃথিবী একান্তে সাজে নিজস্ব জ্যেৎস্নায়
যদি কেউ বলে—অপচয়!
তাদের জন্য অনাদি জলের আখরে
কিছু লিখে যাও।
ফুলের শরীর
কী করে উপেক্ষা করি ফুলেদের আশ্চর্য শরীর!
তবু তাকে নিয়ে যত দাহ, সম্মোহ
প্রেমের নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকার!
সমগ্র উদ্ভিদ জানে তার শিকড়ের তীব্র টানে
কতবার নবজন্ম হল...
তবুও ফুল, ফুলের আশ্চর্য শরীর
ঘ্রাণ—ঘ্রাণ—আর ঠান্ডা স্পর্শ
অকারণে ম্লান করে শূন্যের প্রতিমা!
কিছুতেই ঢাকে না ম্লানিমা,
আরও কত ফুল—ফুলেদের উদ্ধত নীরব পেলবতা
এতবড় আকাশকে বানায় হিমঘর—
পুজোয় ব্যবহৃত উচ্ছিষ্ট পচা ফুল
মন্দিরের দুয়ারে প্রকাণ্ড পাহাড়ের মতো।
তুমি
তোমার নীরবতা সম্মানীয়।
কখনো অভিমানী তোমারও মুখে মেঘ জমে
সমস্ত দিনের জমানো তাপ ছাড়ে জল,
ওদিকে সকলের আহ্লাদিত দিন
সেও তো তোমারই অনুকম্পা!
পরিশ্রমী শরীর
কী করে পেয়ে যায় অপরিবর্তন!
ওদের বসন্ত ফুরিয়ে নামে তাপ
ওদের সুখী মনে পরাজয়ের গ্লানি...
তখন তুমি ছাদে কাপড় মেল
বাতাস এসে লাগে আর কাপড়ে ওঠে ঢেউ—
যেন নানা রঙের মুখর সংসার!
অচিন আলো পড়ে, তুমি সে উত্তাল
সমুদ্র এবং মৃদু আলোর পাশে নীরব সৈকত।
সুদূর ডাক পাড়ে, কাপড় মেলা ছেড়ে
দ্রুত গতিতে নামো, অতলান্ত জলে।
বুদ্ধ
সকলেই বুদ্ধ হতে পারে
বুদ্ধত্বই শেষ পরিণতি, নির্বাণ—
মহামানবের বাণী আলো-অন্ধকারে শুনি
আরও অন্ধকার রক্তের শিখরে উদিত মুক্তি-সূর্যের মতো…
কখনো বুদ্ধের ছায়া ভেসে যায় বহু দূর
তবু তার অভিমুখ আমারই দিকে ফেরানো!
মরীচিকা হই রোজ—নিজেরই নিকটে ভালোবাসা
লোভনীয় চোরাবালি! তখন অঝোরে কাঁদে বুদ্ধ
বোধিবৃক্ষের শরীর জুড়ে কালবৈশাখী—
যে বৃক্ষের তলে কালজয়ী ধ্যান
অমৃত্যু লোকের শান্তি স্বাগত রেখেছে
সেখানে জীর্ণ পাতায় প্রত্যাশার রসময় উৎসব!
আমি কি মৃত্যুর মতো নির্বাণ চাইব?
কতবার এ নাছোড় প্রশ্নের উত্তরে জানি
বুদ্ধত্ব মৃত্যুর মতো—প্রাণের অমল অধিকার।
শূন্যতা
যাকে তুমি শূন্য বলো
সেও কত স্মৃতির আড়ালে
যত্নে রাখা ছবি
পরতে পরতে তার শিহরণ
যেন রাতের সরোদে কাঁপে নক্ষত্রদল
সে এক অনন্ত সংগীত
চরণে বাজে মৃদঙ্গ
আর আকাশ ছাড়িয়ে যায় সুর
যতই শূন্যতা দাও
রাতের বাগান ভরে যায়
বাসর-ফুলের গন্ধে
মাতৃবিয়োগ
একঝাঁক পাখি আকাশ কাঁপিয়ে উড়ে গেল
নিথর মায়ের বুকে কান্নারতা রমণী-আকাশ...
একটা পাতা দীর্ঘক্ষণ বাতাসের সঙ্গে কথা বলে
পরিশ্রান্ত, নেমে এল পায়ের কাছে, বলল
এ বিচ্ছেদ কার? গাছের না আমার?
আমি নিরুত্তর।
পাতাটিকে বড় বেশি সবুজ দেখাচ্ছে না!
যে ভালোবাসায় পাতাটি বৃক্ষলগ্ন ছিল
সে ভালোবাসাটির কী হবে ভাবি--
সেও কি আহার্য হবে মহাকালের পৈশাচিক ভোজে,
নাকি রমণী-আকাশকে ভরিয়ে দেবে
করুণ রক্তরাগে!
আত্মীয়
কথা হল সমুদ্র বিষয়ে
অনেকদিন পর মনে পড়ল
কোনোদিন হেসেছিলে অম্লান
তিমিরসাগরের তটে বসে। বহুদিন হল
চিরস্মরণীয় ঢেউয়ের মেখলা
সময়ের রিক্ত অভিমান আর নিত্যদিনের
অতি প্রয়োজনীয় আলাপচারিতায়
পাথরের মতো ভারী।
অনেকদিন পর কথা হল
আকাশের পটভূমি বিষয়ে--
ধূর্ত মাছের চাহনি, চুলচেরা কর্তব্যপালন
বাজারের নিরর্থ চিৎকারে যা ঢাকা পড়েছিল
আমাদের শূন্যতাভরা বালিশে।
অনেক অনাত্মীয় দিনযাপনের পর
আবার মনে হল আমরা নিকট আত্মীয়।
জন্মের কথা
তোমার জন্মের কথা, কিংবা জন্মস্থান
শীতল প্রত্নের গায়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা!
তুমিও ঠিক জানো না—কোন সার্থকতা
অনন্ত শূন্যের জলে প্রেমের স্পন্দন।
এই চেয়ে থাকা—দূরে যত দূরে গেলে
মনে হয় আমাদের অব্যর্থ স্বভাবে
রয়ে গেছে কোনো ফাঁক—দুঃখ জানাবার
কেউ ব্যতিক্রমী নয়—ব্যতিক্রমী প্রেম
একই উপাদানে গড়ি ভিন্ন আয়োজন।
গৃহের প্রসন্ন রং সব সাজ ভুলে
আরও স্বাভাবিক হবে যেমন দর্শক
বিশাল পাহাড় দেখে মুগ্ধ ও নির্বাক।
যাওয়ার দিন
লেবুর সুগন্ধে ভরে আছে বাগান
অম্লতার আরও গভীরে
অনাবশ্যক রোদ নিঃসঙ্গ কিশোরীর মতো
ভ্রাম্যমান সমস্ত বাগানে।
আজকে কারো যাওয়ার দিন
কে বেশি বিহ্বল অমল বাগানে?—
যে যাবে, নাকি যে চায় না কেউ সরে যাক দূরে
কে সেই কিশোরী?
অজস্র ফুলের ঘ্রাণ ঢাকা পড়ে
পলেস্তারা-খসা দেয়ালে অবোধ্য শ্যাওলার চাদরে
যেমন একদিন বাইরের আলো-বাতাসের চেয়ে
আমাদের বুকভরা মেঘে কেউ
মৃত্যুর অতীত আশ্রয় পেয়েছে।
অভিমান
যেতে পারি কোনো অভিমান ছাড়াই।
চলন্ত মেঘের দুর্নিরুদ্ধ বেগ আমার চলায়
সহজে মেলাতে পারি
পৃথিবীর প্রতি বিনা পক্ষপাতে...
অথচ বৃষ্টি চেয়েছিল কেউ
নিরভিমান দিনের আড়ালে
চেয়েছিল কেউ আষাঢ়ের সঞ্চয়
তাই দেখো , আমারও বুক ভারী হয়
ভারাক্রান্ত মেঘের মতো।