এই মাসের কবি : শুভদীপ নায়ক
আলাপ পর্ব
কবি, অনুবাদক, সাহিত্য সমালোচক, প্রাবন্ধিক, শুভদীপ নায়কের জন্ম ২০শে অক্টোবর ১৯৮৯ সালে কলকাতার বেলেঘাটায় । বাস্তুবিদ্যা ও কারিগরী বিদ্যায় স্নাতক, বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর । বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকুরিরত । পেশার পাশাপাশি সাহিত্য ও তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে লেখালিখি করেন । কবিতা লেখার সঙ্গে, কবিতার দর্শন, প্রবন্ধ, গল্প, পত্রসাহিত্য, উপন্যাস ইত্যাদিও লেখেন ।
মূলত অস্তিত্ববাদী দর্শন নিয়ে এর আগেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে একাধিক পত্রিকায় । ক্লাসিক রোম্যান্টিক কবিতা, স্যুরিয়ালিস্ত কবিতা, আধুনিক কবিতা ও পোস্টমর্ডান কবিতা হল এই কবির লেখার উপাদান ।
অনুবাদের ক্ষেত্রে টি এস এলিয়ট, উইজলা সিম্বোর্স্কা, ব্যাঞ্জো প্যাটারসন, গিলি হাইমোভিচ, জাঁ জেনের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন । কবিতার পাশাপাশি সাহিত্য সমালোচনা ও লিরিক্যাল পোয়েট্রি লেখেন ।
প্রকাশিত দুটি কাব্যগ্রন্থ : নির্বাক মুহূর্তগুলো (২০১৬), আত্মহত্যার স্নানঘর (২০১৭)
কবিতা
শুভদীপ নায়কের কবিতা
আঁধারমথের মতো এসেছিলে
আমি বুঝিনি , অবেলায় কী দিতে এসেছ !
একটা শান্ত স্রোত আমায় দোষারোপ করেছিল
তোমাকে ঘরে রাখলে এই বুঝি ভেঙে পড়ে সুখ
তোমাকে জড়িয়ে ফেললে নিন্দা ঘিরে ধরে মেঘে মেঘে !
ঋণ, বাস্তুজমি, পুরনোদিনের ছাতা, অব্যবহৃত
কাঠের চেয়ার, সবই তো রাখা ছিল ছাদে
তবু আমাকে পুকুরপাড়ের দিকে নিয়ে গেলে,
সঙ্গে পায়রা গেল, বিড়াল গেল, বাঁশপাতা ঝুঁকে পড়ে
জলের শরীর ছুঁল নিস্তরঙ্গ চুম্বনে
চোখ বুজিয়ে শিউরে ওঠাই কি তবে মেয়েদের ভালবাসা ?
দুর্দিনে রামকিঙ্করের ছবিগুলোতে নামে স্বপ্ন
আমার নেশার ঘরে তোমাকে
বসতে দেওয়ার জায়গা নেই, কাগজপত্র, ছায়া, রঙ,
সারিসারি বই আর পত্রিকা ভরে আছে কীটে
এ ঘরে তুমি ব্লাউজের হুক লাগাবে কেমন করে ?
কেমন করে অন্ধ হবে আর ভুলে যাবে
নিয়তির গা ঘেঁষে সবটা দিয়েছিলে গন্ধে !
ঘৃণা
সম্পর্কেরও একটা সীমা আছে, সেটাকে ছাড়িয়ে গিয়ে
মেয়েটা বলল, 'কী করে, কী করে এসব লিখতে পারেন ?'
বললাম, তরল আগুনে গা ভাসিয়ে বাঁচি, তাই পারি ।
'মিথ্যে, সব মিথ্যে ।' বললাম, সত্যিটা তা হলে কী, শুনি ?
শুনে চুপ করে গেল, আমি শুধু বুক ভরে শ্বাস টেনে দেখি,
সমুদ্র হাওয়ার গন্ধ ওর শরীরে, হাত দিয়ে দেখি, মুখময়
ভরে আছে নোনাবালি, নীল জল, গভীর কলঙ্ক ও ঝিনুকে ।
বললাম, কী এসব ? ও বলল, 'চৌর্যবৃত্তি ।' বলল, 'অতল ।'
আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই অতল থেকে তুলে আনলাম মুক্তো,
তুলে আনলাম হাঙরের ক্ষুধিত স্বভাব, অক্টোপাসের গোঙানি !
ও বলল, 'এতদিনে সার্থক হলাম ।' বলল, 'এতদিনে ফুটে ওঠা দুধ
পাত্রের গা বেয়ে উপচে পড়ল, বিশ্বাস করুন !'—বেশ, তাই করলাম ।
বিছানায় দু'জনের এঁটো লেপ-তোশক পড়ে আছে, খাতা পড়ে আছে,
ঝর্না কলম আছে বালিশের নিচে, ওর ব্রা আছে, তাপ আছে,
গন্ধ আছে । আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'অসভ্য ।'
রক্ত ফেনিয়ে উঠল, কোথাও কি লুকানো ছিল জীবনের সুধা ?
ও বলল, 'ছিল তো, আমার বুকের নিচে ।' বললাম, ফলের বাগানে ?
বলল, 'হ্যাঁ !' জানতে চাইলাম, কীভাবে ? বলল, 'বেদানার রসে,
আঙুরের থোকাতে, তরমুজের দানায়, বেলের আঠাতে ।'
ওর গায়ে এখন রোদ পড়েছে, আমার পেটের মধ্যে গত রাত্রের মদ-মাংস
তখনও বেঁচে,—ওর চুল, গ্রীবা, ঘাড়, স্পাইন, এসবের ওপর হাত বোলাচ্ছি,
হঠাৎ বলল, 'জানেন, প্রেমিকের মতো প্রেমিক পেলে নষ্ট হয়েও সুখ !'
এমনিভাবে হৃদয় ছিঁড়ে, করোটি ফাটিয়ে, হাড়গুলো ছিন্নভিন্ন করে
কোলে বসে বুকের গভীরে সে লিখে দিল ক্ষমা । বললাম, কী লিখলে ?
ও বলল, 'আপনাকে না পাওয়ার অসুখ, ভালোবাসতে না পারার ঘৃণা !'
হঠাৎ আলাপ
যুবতীকে বললাম : কী ফেলে যাচ্ছ ?
'কই কিছু না তো !'
ঠিক করে ভেবে বলো, ব্যাগে এত বই, বই মানে ভালবাসা,
বই মানে আত্মার তুমুল খিদে,
গরিবের রেশন দোকান, ভিখিরির পাত্র,
প্রেমিকের আদর । ভাল করে দ্যাখো—
এগুলোর একটাও ফেলে যাচ্ছ না তো ?
উঠতে গিয়েও বসে পড়ল সে ।
বলল, 'মোটেই না, ব্যাগ ভরা মরমিয়া সুখ !'
জানতে চাইলাম, কী কিনেছ দেখি ?
অমিতাভ দাশগুপ্ত ?
বলল, 'না ।'
তবে কি অলোকরঞ্জন ?— 'না ।'
জয়ের ক'খানা বই, দেখি ?
'মোটে দুটো ।'
ব্লেকের কবিতা যদি কিনে থাকো, অনুবাদ করবে ।
'কিনিনি ব্লেক, লোরকার সনেট নিয়েছি ।'
রিলকের লেখা যদি পড়ে থাকো, চিঠিতে জানাবে ।
যুবতী বলল : 'আজ বেশি কিনিনি, এসেছি তো
গল্প করব বলেই ।'
তা হলে দুটো কফি নিই ? না কি মদ খাবে ?
'জানি না, কফিই নিন ।'—এই বলে
চুলের বিন্যাস ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে,
স্লিভলেস ভেঙেচুরে উল্কি গেল দেখা
একটা স্ট্যালিয়ন ঘোড়া বুকে কিছু
পাওয়ার আশায় কাঁধ থেকে ছুটছে ।
বললাম, এনেছিলে এতকিছু, না দিয়ে চলে যাচ্ছিলে যে ?
টেবিলে নজর পেতে মনমরা হয়ে গেল সে ।
—কী হল ? আনোনি ?
যুবতীটি বলল : এনেছিলাম, পুজোর প্রসাদ,
হৃদয়ের ফুল, কাগজের নৌকো
জীবন ও নাটক, —আর....
এসে গেল কফি, বললাম,— আর ?
সে বলল, 'দ্য ডিভাইন কমেডি, দ্য জার্নি অব সোল'
আদর
মেয়েটি বলল, 'মরে যাবে, যাও । আমার শাড়ির পাড়ে
তবু দু'জনের বদনাম লেগে থাকবে ।'
'ভুলে যাবে, যাও । আমার অশান্ত ঢেউ এসে
তোমার সাজানো সংসারে হঠাৎ আছড়ে পড়বে ।'
'আমাকে অস্বীকার করবে ? তা অবশ্য করতে পার,
কিছু পাব ভেবে তোমার মুখের কথায় সবটা দিইনি ।'
'চলে গেলে চলে যেতে পার, আমি তো গলায় দড়ি দেব না ।
কেরোসিন ঢালব না গায়ে, ঘুমের শিশিও পাবে না পুলিশ
আমার লাশের পাশে, এমনই অভাগী আমি, বিদূষী প্রেমিকা !'
আমি দেখলাম, ওর স্তন থেকে সরে গেছে কাপড়ের আড়াল ।
শরীরে স্পৃহা আছে, দু'কাঁধে নরম চুল, একজোড়া টানা চোখ,
কোমর বন্ধনহীন, অর্গলমুক্ত, ওখানেই ওৎ পাতে সৌন্দর্যশিকারি—
বুকের ফলন কত শস্যময়,— সেকথা তো আগেই লিখেছি ।
কিন্তু আত্মার চিৎকারটুকু, নিঃশ্বাসের আর্তিটুকু কখনও লিখিনি আমি !
লিখেছি পেটের মেদ, গ্রীবার ঢাল, লিখেছি বুকের মাঝে
পুরুষের আরোগ্যপথ দিগন্তে চলেছে, সেই পথে আমিও যদি
হেঁটে যেতে চাই, ডুবন্ত সূর্যের লাল, তার দুই পাঁতিহাস ঠোঁটে !
বিক্ষোভে বিচলিত হই, প্রেমেই আসক্ত আমি, কেননা বয়স চৌত্রিশ !
অনিবার্য হাতাহাতি হল, ওর চুল ঘেঁটে গেল, প্রথমে আঙুলে আঙুল,
তারপরে ঠেস দেওয়া কঠিন দেওয়ালে, চিবুক লেপ্টে গেল,
রশ্মিজালে দুলতে থাকা দুটি অর্ধগোলক যেন অতৃপ্ত কবিতা ।
আমাকে কামড়ে দিল, বাঁ-হাতের কবজিতে এঁকে দিল দাঁতের ঘড়ি !
এরপর ভেঙে গেল বাঁধ, কোথাও তুমুল স্রোত, কোথাও শ্রান্ত ঝিরিঝিরি—
ঠাস ঠাস দুটো চড় দু'গালে বসিয়ে থুঁতনি ধরে বললাম, 'ভালবাসো ?'
আনন্দে বিহ্বল হল ঠোঁট, জানি,—দক্ষতা তার চরিত্রের অন্দরে
আমি যাকে স্পর্শ করি, সেই মেয়ে হয়ে ওঠে শিল্পীর সাধনা
আমি যাকে টেনে নিই স্বরলিপি সুরে, সেই মেয়ে হয়ে ওঠে গান !
ঝড়ের কাঁপন দিয়ে এল, ভালবেসে, চুমুতে, ঈর্ষায়, ব্যথার মোচড়ে,
আমাকে সে ভরিয়ে দিল, আমিও পা দিলাম ঐ বৈদ্যুতিক তারে
যেটুকু লেখেনি কোনও ধর্মের ঈশ্বর, সেইটুকু চেটেপুটে লেখা হল
ফুটে ঘন হয়ে এল অপেক্ষার দুধ, উপরে সর ভাসে, ভিতরে আদর !
বিস্ময়
রত্মকে যতই লুকাও গভীরে, তবু সে দুলে ওঠে দ্যুতিতে
স্পর্শ যতই ছড়ানো থাক চামড়ার নিচে, তবু সে ফুটে ওঠে লোমকূপে
সর্বাঙ্গে যতই জড়াও শিফন, তাঁত, শান্তিপুরী, মরণে ওরা কেউ থাকে না সঙ্গে
রমণ সুখের শেষে কোথা থেকে ছুটে আসে ঈর্ষান্বিত কালঘাম, বলতে পার ?
এই তেজ, এই ঘাম, এই লবণাক্ত ইচ্ছে কি আগে থাকতে বসে ছিল না রক্তে ?
তুমি তো ছিটকিনি দিলে, আমিও জানলা দুটো বন্ধ করে দিলাম,
বলতে পার, এর পরেও কোন্ ছিদ্রপথে ছুটে এল আদিগন্ত আলো ?
তুমি যে লজ্জা নিয়ে ডুবেছিলে উঠতি বয়সে, কীভাবে তার সব কূল ভেঙে
আজ এই বানভাসি দশা হয়ে গেল ? শৈশবের সব জেদ ভাঙল যৌবনে এসে ।
বইয়ের পাতায় আমি প্রথম যখন ম্যাডোনাকে দেখি, জানতাম না ওর ত্রিমুখী রূপ !
ইতিহাসে যখন ক্লিওপেত্রার কৃষ্ণঘন শরীরকে খুঁজে পাই, দেখিনি ও কতটা বিষাক্ত
তুমি আফ্রেদাইতের মধুময় বুক দেখেছ ? কে বলবে ওটা মমত্ব নয়, নিষ্ঠুর যৌনতা !
ভেনাসের মুখের আদলে আমি যতবার আলো ফেলি, দেবী নয়, ডাইনির ছায়া পড়ে
হোমাগ্নি আলোক নেই, শুধু কণ্ঠরোধী শীতল অন্ধকার ! —মেয়েপুরুষের মধ্যে ।
কেউ বলেনি, আমরা মিটিয়ে নেব সংগ্রাম, দু'জনে যা পারব, যতটা পারব
অপরের দেনা শোধ করে চলে যাব দূরে, যেখানে দূরত্ব নিয়ে কিছুকাল বেঁচে থাকা যায় !
তুমি তো স্কচের গ্লাসে দিলে না ঘুমের বরফ, নিজেই নিলাম ভ্যালিয়াম টেন
সৌন্দর্যের সংজ্ঞায় আমি পেলাম তোমাকে, তুমি বললে, 'শিরায় ছুটেছে
তপ্ত রক্তের স্রোত, স্নায়ুতে বিষণ্ন রঙ, মাংসে বিঁধেছে মর্মর কাঁটার প্রান্ত,
এখন এসব নিয়ে আমিও নিরুপায় ।' সারাটা জীবন ধরে মজ্জার ভিতরে
এই যে আমি ঘুরে বেড়ালাম, ওয়ার্ডসওয়ার্থের চেতনায় হাত চালালাম,
এসবের মূল্য বুঝি ঐ বিস্ময় ? ক্রমশ ছড়িয়ে গেলে লিভার, স্প্লীন, কিডনি,
ও পাকস্থলিতে কিছু একটা জুটে যায় । কিন্তু হার্ট, ওর কী হবে ? ও তো অসহায় !
তাই তুমি চুমু খেলে, পুতুল খেলার দিনে ভেবেছিলে কি কখনও মানুষকে জড়িয়ে
মানুষ কত কিছু রেখে যায় ? হাসলে তুমি । বললে, 'ঊম, বাদ দাও এত হিসেব নিকেশ
এসো, ভিজতে থাকি আঁধারে, এমন কি আছে আমার কোণায়, যা নীল, যা লাল,
যা উত্তাপে বেগুনি !'— বললাম, অনলি দ্য ওল্ড সি, নাথিং টুয়াইজ ।
জ্যোৎস্না
পারতেন তো আমার আগুনে জল ঢেলে নিভিয়ে আশ্বস্ত করতে, করেননি !
বরং, ঘিয়ের শিশি উপুড় করে দিলেন, দাউদাউ, আগুন ছড়ালো—দু'জনের মধ্যে
আপনার তো সংসার গেল, স্বামীকে হারালেন, কুলটা হলেন,— জানেন আমার কী হল ?
জীবন হারিয়ে আমি ঘুরলাম পথে পথে, একা, সৃষ্টির খোঁজে, অমরাবতীর সন্ধানে ।
কবিতার স্তবকে যে লুকানো স্পেস আছে, ভর্তি করলাম বারুদে, পাপে, ঐশ্বর্যে—
শব্দে, অক্ষরে, দাড়িতে, সেমিকলনে, কত আঁকলাম সচিত্র যন্ত্রণা, শুধু আপনাকে পাব বলে
এই দেওয়ালের পাশে খোলস ফেলে পালিয়ে গিয়েছে গোখরো সাপ,
এখানেই শঙ্খ লেগেছিল আমাতে ও আপনাতে ।
তখন নব্বই সাল, সৌন্দর্য ভিখারি আমি ! কারো চোখে হীন, কারো চোখে
কদাচিৎ স্বার্থপরও হয়ে উঠি । সে এসে জেদের বশে বলল, 'খুন ও লুঠের মাঝে
কবে যেন আপনার প্রেমিকা হয়েছি । ধর্ম থেকে সরে, জীবন থেকে নেমে,
আমাদের একাত্ম শরীর-মনে শেষ কবে ফুটে ওঠে প্রেমের ছত্রাক, বুঝিনি !'
কাগজের ফুল বানিয়ে ওকে দিলাম । ও বলল, 'পুরুষের ফাঁকি !'
বললাম, কাগজের ফুল তো শুষ্কতা জানে না, বয়স চেনে না, ওর নেই কোনও
ন্যায় অন্যায় বোধ, স্পৃহা আছে, পবিত্রতা-- তাও লুকিয়ে রাখে পাপড়ির নিচে !
শুরু হল ঈর্ষা, ক্ষোভ, আগুনের বিরাট প্রহেলিকা । ভালোবাসি কিনা, সে জবাব চাই ।
আমিও দিলাম তাকে অন্ধকারে ঠেলে, বিভীষিকা, বিক্ষোভ ও বিতৃষ্ণা---এই হল নেশা,
এই হল বিপুল আঁধার ঘিরে বেড়ে ওঠা শব্দহীন কণা, ঘ্রাণ ।
এ ওর ঠোঁটে খুঁজে চলি প্রেম, নীল-লাল-বেগুনি মনের কোণে ফুটে ওঠে হলুদ জ্যোৎস্না!
আসন
বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেল জমি, আশ্রয়, বেঁচে থাকা
ও বলল, 'আপনারই দোষ, বাঁধে রোজ মাটি দেওয়া চাই,
চাই সবুজ বয়সের অরণ্যরোপণ, ছড়াতে হবে বীজ !'
বললাম, 'ভিতরে জলোচ্ছ্বাস এত, বালি আর জলের
এত যে নিপুণ তাড়না, কী করে জানব প্লাবিত হবে এসব বসতি ?'
শুনে হাসল, চিবুকে আঁচল টেনে যেই না দুহাতে খুলেছে খোঁপা
অমনি আকাশে কালো মেঘ, চারিদিকে হু হু হাওয়া, ঘূর্ণি
দু-ঠোঁটে লোভের হাসি, চোখে অনেক জিজ্ঞাসা জমা
বলল, 'মেয়েরা মনের তাস লুকায় শরীরে !'
সে রাতে ডুবল সব, ভেসে গেল হাঁড়ি, ভেঙে গেল ঘর
ও বলল, 'এই হল প্রকৃতি, বয়স আর বাঁধন মানে না ।'
চেয়ে দেখি ভেসেছে উঠোন, অন্যের বাড়িঘর, গোয়াল আর
অদূরে মাছের ভেড়ি, গাছপালা ন্যাড়া হয়ে আকাশে তাকিয়ে,
আমাদের নুন নেই, চাল নেই, শুধু আছে কপালের দোষ
গবাদি পশুর দল সারি বেঁধে চলে গেছে দূরে,
শুধু আমি আর ও, আমরা পারিনি এই বিষের শাসন থেকে
নিজেদের সম্ভ্রমে পুনরায় ফিরে যেতে ।
পরনে রঙিন শাড়ি, ফিরে পাওয়া মাটির বাসন, আর কিছু
খড় কুটো নিয়ে আদরে আদর মেখে রোদ এল ঘরে
সেই থেকে পুনরায় বাঁধে দিই মাটি, বুকে খুঁজি ঢেউ
ও বলে, 'এই হল সুখের সঞ্চয়, এই হল প্রেমের আসন !
লেডিবার্ড
তিরিশের শিক্ষিতা যুবতী বলেছিল, 'চিরদিন
আপনি কি এসব বইপত্র নিয়েই থাকবেন ? নাকি
এ ঘরে কোনও জীবন্ত ফুলগাছ আনবেন ?'
আমাকে নিরুত্তর দেখে নিবিড় শরীরমনে
টেনে নিল একখানি বই, বলল, 'প্রমিথিউস আনবাউণ্ড!'
বইটা বন্ধ করে কাছে এসে ক্রসড লেগড বসে
নীরবে তাকিয়ে থেকে বলল, 'আপনার মনে বুঝি
ফলের বাসনা নেই ? নতুন বীজের নেশা ?
কাঁচা মাটি পুনরায় পাকিয়ে তোলার কোনও স্বপ্ন ?
বললাম, যে হাতে গ্রিক ট্র্যাজেডি, শেলির ড্রামা,
সেই হাত ভরে যাক গোলাপের তোড়াতে, অথবা
হিংস্র পশুর কোনো ক্যানাইন দাঁতের মতো
ধারালো ছুরিতে, কখনও কি তুমি তা চাইবে ?
লেডিবার্ড সামান্য হেসে মেলে ধরল শেলিকে
এই ফাঁকে সিগারেটে আগুন জ্বেলেছি, ওর মনে
বিষের মহিমা, আমারও গভীরে রাখা রুদ্রকাম
বিদ্যুতের বেগ, এইসব নিয়ে যখন জীবন চিনেছি
বুঝিনি, ঈর্ষা গোপনে আনে পোড়া রোদ, সংকট,
হৃদয়ে মেঘের ছায়া ! ও বলল, 'মৌচাকে মধু ভরে এলে,
ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করে জমিয়ে তুলে নিন
কাচপাত্রে, মোমের শরীরটুকু না হয় গলে গেল তাপে
না-হয় তুমুল ঝড়ে সবকিছু তছনছ হয়ে গেল
তবুও কাহিনি ছিল, মেয়েদের কাছে এটুকু অনেক!'
লোভ
(যে ছিল মোহনগামী, সেই আজ সপ্তলোভী তারা)
১
জীবন অদ্ভুত ! বিকেলের চেয়ে যা সামান্য ফিকে
রাত্রির চাইতে যা নিশ্চিদ্র গভীর, অন্ধ অপরূপ
বিরহে ভাঙে না, ক্ষুধায় টলে না, মগ্ন চতুর্দিকে
মনে হয়, ভাষায় ছড়িয়ে আছে জীবনের স্তূপ
মা আমাকে জন্ম দিয়ে মারা যায় বলে একা আমি
পেরিয়ে গিয়েছি সব ধূসর বাগান, নদীকূল--
শরীরে কুঠারাঘাত, দণ্ড পায় আমার আগামী
সরেস মাটির বুকে ফুটে ওঠে দুগ্ধময় ফুল
সে ফুলে গুটির মতো জেগে আছে লোভনীয় বোঁটা
তীব্র নয়, স্থূল কোনও অগ্নিশিখা সুচরিত প্রাণে
রুদ্রকাম বয়ে চলে, ঝরে পড়ে হৃৎ-রক্ত ফোঁটা
শ্রাবণ ডিঙিয়ে তাকে নিয়ে এসো কার্তিক অাঘ্রানে
সিঁদুরে আপত্তি নেই, দেহ তো মিশেই গেছে ধীরে
বাধা আছে শুধু তার হৃদয়ের অনেক গভীরে
২
ঘামে ভেজা নতুন ব্লাউজ খুলে, যুবতীটি বলল
'নিন, খুব যে সেদিন তিল খুঁজছিলেন, দেখুন তো
তিল পান কি না এই নীহারিকা খুঁড়ে !' চেয়ে দেখি
সমুদ্রের শঙ্খ উল্টে রাখা, ভাষা নেই, স্তব্ধ বৃন্ত !
'কী আছে আমার মধ্যে ? রত্ন ? সুধা ? সুখ না সন্তাপ ?'
ছুঁয়ে দেখব সাধ্য কই, তার আগে তুমুল শিখায়
সে ধরে উঠেছে নিজে, যেন এক আকাঙ্ক্ষিতা নারী
ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে ওঠে, কথা দিয়ে জড়ায় আমাকে!
সূর্য আর পূর্ণ চাঁদে তফাৎ যেখানে, আমি ও সে
ততটা দূরত্বে থাকি, গভীরে লুটিয়ে পড়ি পাপে
'বলো, কোন্ অঙ্গে তুমি ছুঁলে পুনরায় প্রেম পাব ?
কোন্ তৃষ্ণা ভরে গেলে ভেসে যাব অকূল তিমিরে ?'
কোমল আঙুল দিয়ে চিত্র আঁকি গোপন দেওয়ালে
গহনে মেলাই সুর, স্বপ্ন ভাসে বিদীর্ণ পলাশে!