এই মাসের কবি : সঞ্জনা রায়
আলাপ পর্ব
পূর্ব বর্ধমান জেলার গোপালবেড়া গ্রামে সঞ্জনা রায়ের জন্ম ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি। প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে রসায়নবিদ্যার এই ছাত্রী বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। কবিতা লেখা ছাড়াও ফোটোগ্রাফি-চর্চায় তাঁর অংশগ্রহণ নিয়মিত। জনপরিসরে ছড়িয়ে থাকা অতি সাধারণ জিনিসপত্র সচরাচর তাঁর আলোকচিত্রের বিষয়। তাঁর তোলা আলোকচিত্রের ব্যবহারে বাংলাভাষায় প্রকাশিত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের প্রচ্ছদ নির্মিত হয়েছে। প্রকাশিত কবিতার বই একটি, 'সময়, তার প্রতিবিম্ব', বেরিয়েছে ২০১৯ সালে। সঞ্জনার সাথে যোগাযোগ করতে হলে মেল করুন rsanjana100@gmail.com এই ঠিকানায়।
কবিতা
সময়ের অসহ্য নকশা
ডিম্বাকৃতি পাথরের ওপর থেকে
চাপ-চাপ বিষাদের রূপ ধরে উড়ে গেল গোলাপ,
এই রূপান্তরের কোনো শব্দ হল না,
ঘুমন্ত রমণীরা গোড়ালিতে শিরশিরে বাতাসের
বয়ে চলা অনুভব করল শুধু।
এখন চাঁদ উঠলে স্পষ্ট দেখা যাবে
গোলাপের শরীরে সময়ের অসহ্য নকশা ফুটে উঠছে।
মেয়েটা চাঁদ পেড়ে আনতে চাইছে
চুল এত নরম যে, মা পাখিরা
ছানাদের রেখে নিশ্চিন্তে উড়ে যেতে পারে,
আর বাতাস নকশা কেটে নকশা কেটে
ঘুরে ঘুরে নকশা কেটে
শরীরকে বানিয়ে তোলে কারুকাজ করা
হাওয়াগাড়ি, তাতে ফুল সাজিয়ে দেয়---
এই আহ্লাদে মেয়েটা চাঁদ পেড়ে
আনতে চাইছে, আকাশটা
নীচু করে টেনে ধরেছে এক হাতে---
তার বুক ভরে যায় বিচিত্র আকৃতির
নীল রঙের পাতায়, ভারী হয়ে আসে
তুলোর পোশাক। পিঁপড়েরা
মাটিতে পড়ে ভেঙে যাওয়া চাঁদের
টুকরো মুখে ধরে
এনে জড়ো করছে তার পায়ের কাছে।
নিশ্চল পৃথিবীর কেন্দ্রে
কাকভোরে কারা এত সারিবদ্ধভাবে হাঁটছে--- ভাবতে ভাবতে
মৃত্যুর কাছে খানিক সময় চাইলাম,
রাস্তার দু-পাশের গাছেরা বুক খালি করে
সমস্ত ভেজা বাতাস এনে রেখেছে
হাঁটবার সুপ্রশস্ত পথে, ওদের কোমরে
কুঁচকে যাওয়া সাদা বোঁচকা।
মৃত্যুকে যেখানে দাঁড় করিয়ে রেখে এলাম
আকাশ জুড়ে অসংখ্য চাঁদ সেখানে,
যাত্রার শুরুর দিন থেকেই গায়ে-গা-লাগিয়ে
পড়ে থাকা চাঁদগুলো এদের শক্ত মুঠোর ভেতর ঢুকে
আরও নিদারুণ কোনো রূপ পেতে চাইছে,
সমস্ত দিক-সচেতন নক্ষত্র
নিজেদের বিন্যস্ত করে যাচ্ছে অসীমে।
লোকগুলো রাস্তার ফাটল ধরা মাইলফলকের কানায় ঝুলে থাকা
সুপরিকল্পিত মৃত্যুর কাছে যায়, কালো জলায়
গা ডুবিয়ে থাকা মৃত্যুর কাছে যায়, জীর্ণ বাড়ির
দরজায় লেগে থাকা ছোপ ছোপ মৃত্যুর কাছে যায়।
নিজেদের চোখ খসিয়ে রেখে আসে, আবার হাঁটে---
নিশ্চল পৃথিবী কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে হতভম্বের মতো দেখে
কেমন করে স্বপ্নেরা হাঁটতে হাঁটতে
তারই কক্ষপথে একের পর এক বৃত্ত সম্পূর্ণ করে চলেছে।
সন্ধির সময়
কালো নদীটার পাশে
মেয়েটা, চাঁদ ডোবার শব্দে
ঘুম ভেঙে দেখে--- কুকুরের পিঠে চড়ে
অন্ধ সূর্য আকাশে চলেছে।
সন্ধির সময়
মেয়েটার ঝুলে যাওয়া স্তন
ফুলে উঠছে, জঙ্গুলে ফুল
গলা বাড়িয়ে বৃন্তে মুখ ঠেকায়।
জলের পোকারা থইথই করছে স্নায়ুতে।
চোখ
দূর থেকে লক্ষ করছিলাম কীভাবে সন্ধ্যা হয়---
আকাশ মাটিতে নেমে আসে
কাচপোকাদের কুড়িয়ে নিতে, আমাদের
আকাঙ্ক্ষার কারণগুলো গম্ভীর বৃক্ষের আদলে
বাড়িটাকে ঘিরে ধরে, বাতাসের নিঃসঙ্গতা এসে
স্তূপাকারে জড়ো হয়ে বসে, আমরা
ভাবতে থাকি--- এই বুঝি শরীর! ভাবতে ভাবতে
এত যুগ অতিবাহিত হল যে, ভুলে গেছি
স্তনবৃন্ত বেষ্টন করে ঘুরতে থাকা তারাদের।
এখন পলকা পেঁপেডালে ঝুলে রয়েছে
এক-টুকরো জ্যোৎস্না, তার দিকে তাকিয়ে থেকে
নিজের চোখ পুড়িয়ে ফেলি।
নিঃসঙ্গ রাত্রিগুলি পার হয়ে
কিশোরগঞ্জের এক সুরেলা নদীর দুই তীরে
আমরা দুটি জারুল গাছ--- বহু যুগ ধরে
অস্তিত্বহীনতায় ডুবে যেতে যেতে আজ এমন উজ্জ্বল হয়েছি।
ওপারের জারুল পাতা কীভাবে যেন কাঁপে--- কল্পনা করতেই
চাঁদ পৃথিবী নক্ষত্র আমার শাখাপ্রশাখায় এসে দোল খায়।
বাতাসের গায়ে আমাদের বেগুনি রঙের সুগন্ধি বাড়ি, বাড়ি নয়,
মিলনরত ছায়াশরীর--- অবাস্তব রকমের এক-একটি খাঁজ, হাজার
ঢেউ এসে জমা হয়েছে তার ভেতর।
নদীতে আছড়ে পড়া গাঢ় নীল জ্যোৎস্নাকে অবলম্বন করে
বাড়িটি পার হতে চায় নিঃসঙ্গ রাত্রিগুলি।
যেভাবে হিজল গাছ
আধখোলা দরজার সামনে গিয়ে
তোমার কথা জিজ্ঞেস করি, হিজল গাছ নড়েচড়ে ওঠে ভেতরে।
কোনোদিন স্পর্শ না করেও জানি তোমার শরীর
হিজল গাছের গমগমে অন্ধকার। যে-দিন খালি গায়ে
ঘুমোবে আমার ছড়িয়ে রাখা হাতের ওপর মাথা রেখে---
হাওয়াভর্তি ফুল ফোটার শব্দ এসে জড়ো হয়ে বসবে
তোমার সুনির্মিত বুকের পাটায়, আমার অসহ্য বোধ হবে---
আকাশের সবচাইতে গম্ভীর মেঘের দুয়ারে
কেন রেখে আসতে পারি না তোমার সহজ সবজে গন্ধ !
হঠাৎ টের পাই, দামাল হিজল গাছ আমার দেহে
ফুটে ওঠা উঁচুনীচু কারুকাজে ভিজে ঠোঁট বোলাচ্ছে---
এভাবেই সে অন্যত্র এঁকে দেবে সুরম্য নকশাগুলি।
দুঃখের মতো
দূরের উপত্যকা থেকে একদল প্রজাপতি
উড়ে এসেছিল, ওদের পায়ে পায়ে তুমি
এসেছিলে দুঃখের মতো, আগুন জ্বালিয়ে। প্রতি রাতে
প্রজাপতিরা চাঁদের গায়ে ঘুমোতে যায়, ওরা জানে
ওইসব সুশীতল রাতে চাঁদই পারে
দুঃখ হয়ে ভালোবাসতে। আর এক গাছ,
সে কেবল পাখিদের মৃত্যুর দিকে
তাকিয়ে থাকে, লক্ষ করে মরবার পরে
কীভাবে পাখিগুলো চাঁদ ঠোঁটে ধরে চক্কর কাটে
সারা আকাশে, তখন যদিও তার পেটের ওপরে
পড়ে থাকা প্রজাপতির ডানায়
চাঁদের বিভিন্ন আকৃতির ছায়া।
আলো
ধিকধিক করে জ্বলছে দুটি স্তন---
সাদা হয়ে জ্বলছে দুটি স্তন।
গড়িয়ে পড়া আলো পৃথিবীর স্বার্থে
পিঁপড়েরা শরীরে ধারণ করছে, অন্য এক পথ দিয়ে
ঢুকে যাচ্ছে গর্তে।
দৃঢ় জমির ওপর শুয়ে পড়ে
নাভির ভেতরে ফুল ফোটার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
প্রতিবিম্বহীন
নয়ানজুলির জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে
পাঁজর বেরোনো শরীরের এক সাঁকো।
গোধূলি তার রঙের পালক পাড়ে খুলে রেখে
পাটাতনের ফাঁক দিয়ে প্রবেশ করছে
অন্ধকারের স্নায়ুর ভেতর।
সেখানে হিজলের ছায়া
কালো জলের নীচে, জলের ওপরে
প্রতিবিম্বহীন সাঁকো নিজেকে দেখতে পায় না---
কাঠ নড়ে, অতি প্রাচীন দেহের কাঠ।