এই মাসের কবি : সঞ্চিতা দাস
আলাপ পর্ব
সঞ্চিতা দাস -এর জন্ম ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪, পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়গপুরে । বাল্যকাল কেটেছে জামশেদপুরে । বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে তিনি স্নাতকোত্তর । তার লেখা 'কৃত্তিবাস', 'নাটমন্দির', 'অস্ট্রিক', 'বকলম', 'শব্দপথ', 'কবি সম্মেলন', 'জলটুঙ্গি', 'তবুও প্রয়াস', 'বাক' ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় পাওয়া যাবে। জীবনের অনেক বিষয়ের মধ্যে কবিতাচর্চাই তার খুশি এবং আনন্দ।
কবিতা
দূত
কে এক কবি যেন নিজের কল্পনা ভেবে আমাকে
চতুর্দিকে রচনা করলেন তপোবন।
কুটিরের দুয়ার খুলে পা ফেললাম,
দেখলাম—
একটা সাদা রঙের পাখি চিরকুট নিয়ে দাঁড়িয়ে,
কাকে যেন খুঁজছে।
আমি এক গাছকে ডাকলাম
সে মাথা নুইয়ে কানে কানে বলল—
বনের জ্যোৎস্নায় আজ কার যেন বিয়ে !
অতি প্রাচীন সব বৃক্ষের তলায় কত ফুল ঝরে শুকিয়ে পড়ে আছে,
হায় হায়!
আমি বিবাহের কথা ভাবতে ভাবতে তাদের গন্ধগুলি কুড়িয়ে নিই ।
পূর্ণিমা
একদিন পূর্ণিমাকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ,
ওই আলোতে জাল ফেলবে ঘন মেঘ,
সমস্ত আকাশ খোলা — ফুল পাড়া হয়নি বলে
ঘাটে ভিড় করেছে যাত্রীরা।
পৃথিবীর স্মৃতিগুলি নক্ষত্রের মতো ফুটে উঠেছে —
তার লাল চোখ, মাথা নত।
বোধ হয় এসব উঁচুনীচু অনুভূতির চূড়ায়
সংসার বসাতে চায় আসন পেতে।
কিন্তু মালী কই ? কোথায় তার অলংকার ?
ছায়া যেন আরও গম্ভীর হল,
দেহ-মনের কুঁড়ি অদ্ভুতভাবে উঠে আসছে
বুকের ভেতর পাক খাওয়া চর থেকে।
এই মেঘের জমিতে এসে মনে হল:
আমি তো এক চক্ষুহীন পশু,
জিভ বের করে কালো চাতালে বসেছি,
পাতার পাহাড় সরিয়ে সরিয়ে
পূর্ণচন্দ্র দেখতে আরও একটা জীবন লাগবে ।
পালক
সাদা পালক উড়ছে । ওই দূরের পাহাড় থেকে
হাওয়া এসে ওর গায়ে ধাক্কা দিল ,
পালকের চোখ এমন শ্যাওলায় চাপা পড়ল যে–
টুকরো কাচের মতো ছড়িয়ে গেল মাটিতে
কয়েকটি ঝুলে রইল গাছের ডালে...
একটা দুটো
শুকনো পাতা আর ফুলের গন্ধ হয়ে পাক খাচ্ছে ।
দশদিক
ঝরা পাতার উপর দেখি
হাড়-পাঁজর ; জোড়ায় জোড়ায় এঁকেবেঁকে
আকাশের দিকে দু হাত ছড়িয়ে রয়েছে ।
যেন পাতাল থেকে উঠে এসেছে এই দুঃখের ডাক
মাটির কুঁজো পিঠ, বুক ভিজে গেছে
ভীষণ স্তব্ধ সময় ...
গা ডুবিয়ে ভাবে—
আর কতটা কঠিন কুয়াশা?
আর কতটা দীর্ঘ পথের পর তেষ্টার জল পাবো ?
সেসব কিছু জানি না। এখন দেখতে পাই -
আমার সমস্ত শক্তি ধীরে ধীরে কেঁপে উঠেছে, হাওয়া দিচ্ছে হালকা
পাতার সঙ্গে উড়ে যাচ্ছে উন্মাদনা...
নির্জনে সমস্ত ফল হলুদের ভেতর থেকে মুখ তুলছে আর
সারা দুপুর ধরে ঝিমোছে দশদিক।
অঙ্ক
মশারির অনেক ফাঁক থেকে আমি সাদা আকাশকে দেখছি, আকাশ আমাকে উপহার দিয়েছে একখণ্ড মেঘ। মেঘ বলল– তুমি নিজেকে ভাঙো। খানিকটা ভাঙা শুরুতেই আয়নাতে দেখলাম একটা জলকাদার জীবন পড়ে আছে, ওর ভেতর আমি কবে থেকে ডুবে আছি জানি না...! এবং তার মধ্যে ঘিরে আছে কয়েকটি গ্রাম, ছোটো ছোটো টিনের চালার ঘর, দূরে তালগাছ, বাঁশবনের সারি, খোলা মাঠ, সরু পথের দু-পাশে ঘাস, হাঁটলে পরে পা ছুঁয়ে মাথা নত করে রাখে, জীবজন্তুর বিষ্ঠা, পশুপাখির কোলাহল, আরও কত কী... গ্রাম আমাকে প্রদীপের নীচের অন্ধকার আর আলোর শতকরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। শহর কংক্রিটের শৌখিন আলো সারারাত জ্বালিয়ে রেখে অঙ্কের লাভ ক্ষতি শেখায়, বোঝাতে চায়। দুজনেই ডাকছে। ওরা ব্যাকুল হয়ে ডাকছে।
রহস্যের আলো-বাতাস
কল্পনার ঠোঁট খুলে চাঁদ বসে আছে—
আঁধফালি চাঁদ। গোলাপজলে পা ধুয়ে
বনপথে হাঁটবে, সেই পথের মাঝ-বরাবর
ছড়ানো লাল কাঁকর,দু-পাশে বানানো
পোকামাকড়ের বাসরঘর , সেখানে উথলে উঠবে
মিলনের জোয়ার– সেই জোয়ারের ভেতর
ঢুকে পড়বে পাখিদের গাওয়া বিয়ের গান,
ফু-চন্দনের রেকাবি, ধূপদানি, আরও কত কী!
হয়তো মৃত্যুর জন্য এতসব তীব্র আয়োজন ।
রহস্যের আলো-বাতাস এসে কেমন গুড়ি মেরে বসেছে ।
শেষ বেলাকার আয়ু
আকাশ-কাটা ধারালো পেখম পুড়িয়ে দিল কেউ,
ধোঁয়া ওড়ার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে।
আমি টের পেয়েছি বলে ছুটে গেলাম, দেখি—
নদী কাঁদতে কাঁদতে ভরে উঠেছে,
মেঘ হাত পেতে ভিক্ষা চাইছে,
মাটি মুখ চাপা দিয়ে মনে মনে যেন বলছে:
গাছে গাছে ফাটল ধরেছে, কষ লেগে আছে গায়ে।
সব খুইয়েও কালো ছাই যেন কেঁপে উঠল,
হাত নাড়িয়ে কী খুঁজে ইশারা করল।
এই বুঝেই ঝরা পাতা এক দৌড়ে গিয়ে
জড়িয়ে ধরেছে তার শেষবেলাকার আয়ু দিয়ে।
শক্তি
আকাশের দিকে তাকাতেই মনে হল কতগুলি সামুদ্রিক পোকা
ঠোঁট খুলে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে কোনো এক আলোর দিকে—
ওদের দাঁত দেখা যায় না, চুলগুলো জলে দোল খাচ্ছে,
গাছের নরম শিকড়ের মতো হাত-পায়ের আঙুলগুলো যেন ভাসছে।
আবার কোথাও কিছু ব্যাঙ উবু হয়ে
কালো কালো চোখ তুলে চেয়ে চেয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে,
কখনো এক-দুটো কচ্ছপ তাদের শক্ত পিঠে ধরে রেখেছে
সাদা শক্তি আর কালো শক্তি
আর তখনই লালা দিয়ে এমন এক ভাসমান পথ তৈরি হতে লাগল
ওই পথ দিয়ে অনেক যোদ্ধা
শুয়ে শুয়ে সাঁতার কেটে কেটে এগিয়ে চলেছে ।
প্রাণ
যখন কোন পাখি গর্ভধারণের পর ধীরে ধীরে উড়ে চলে
তখন তার গতিতে এমন এক মায়া জড়ানো থাকে
যেন বহুকাল তার যন্ত্রণা হয়নি
কিন্তু এবার হবে!
সে জন্ম দেবে তার চোখের মণি।
তারপর থেকে সে একটা ধীর আনন্দে ভাসতে লাগল ।
রাতের ললাট থেকে
রাতের ললাট থেকে বেরিয়েছে মুক্তির সাদা সাদা ফুল –
ফুলের ভেতর অদ্ভুত শান্ত কতগুলো পোকা আছে,
তারা ধীরে ধীরে চলে, ওড়ে না –
পরস্পরকে বলে : জেগে ওঠো, সবাই জেগে ওঠো,
দেখো রাত কেটে গেছে।
ছোটো-বড়ো গাছেরা মুখের চাদর সরিয়ে নিচ্ছে,
ঘাসেরা গা মুছছে,
এখন হলুদ আর লাল রঙেরা ডাগর ডাগর চোখ কুঁচকে
কত কী ভাবছে – ভাবতে ভাবতে
খুলে দিচ্ছে সাতমহলার দরজা ।