top of page

এই মাসের কবি : সেলিম মণ্ডল

আলাপ পর্ব

salim.jpg

সেলিম মণ্ডল থাকেন নদিয়ার চাপড়া। ‘তবুও প্রয়াস’ পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি কবিতা, গদ্য, গল্প লিখে থাকেন। এযাবৎ তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ— ‘মায়াজন্ম’, ‘লবণ খেতের জোনাকি’ ও ‘কাঁচা মাংসের বাড়ি’ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে একটি সম্পাদিত গ্রন্থ— ‘ছাদ পেটানোর গান’।

কবিতা

সেলিম মণ্ডলের কবিতা

 

একটা বয়সের পর মন কেমন স্থিত হয়ে যায়। গ্লাসের জলে মিশে থাকা বালির উদ্দীপন— পতনমুখী হয়। শান্ত জলের চেহারা নেয়। সেই শান্ত জলই কি আমাদের জীবন? জীবন তো নুড়ি-পাথরের সঞ্চয়। তাকে পায়ে পায়ে মাড়িয়ে চকচকে হয়ে উঠতে হয়! তার অমসৃণ শরীরে যেন কোমলতা জাগে...

শান্ত বালির কি তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখনো কখনো মনে ভেঙে যাওয়া বাড়ির কথা... আশ্রয়ের কথা... অথচ গ্লাস আর গ্লাস ভর্তি জল যখন উপচে পড়ে তখনো বোঝা যায়— বালির ক্ষুদ্র শরীরেও কী অসীম ধারণ ক্ষমতা আছে...

 

পৃথিবীর সব থেকে অস্থির জিনিস হল জল। সেজন্যই আছড়ে পড়ে। পাড় ভাঙে। তছনছ করে। জল যখন শান্ত থাকে ভান করে। তার ভান মনোগ্রাহী।

আমি জলের কাছে যাই— তার অস্থিরতা দেখতে। ভেসে যাওয়া পাতায় সংঘবদ্ধ পোকার লড়াই দেখতে। জল আমাকে মনোগ্রাহী করে। তার পাড়ের হাওয়ায় লেগে থাকা কোনো যুবতি বাতাস বলে: তোর কাম নেই? শরীরের দিকে তাকায়। বেলা ফুরালে দেখি— মাছ না পেয়ে ফেরা জেলের গায়ে চুনোপুঁটির রূপালি আঁশ চকচক করছে। সে শরীরে নদী নিয়ে ফিরছে। তার নদীতে থই থই করছে জল।

জীবন মসৃণ হোক চাই না। আমি চাই— জীবনের গায়ে লেগে থাকুক অজস্র গুটি বসন্তের দাগ। খসখস করুক। বন্ধুরা, শত্রুরা যেন পিছলে যাওয়ার ভয়ে পা টিপে টিপে না-হাঁটে। প্রেম আসুক ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। মরণসাঁকোর মতো হোক তার সংযোগ। আত্মহত্যার হুমকি থাক। থাকুক কান্নামিশ্রিত আবেগ।

 

জীবন আসে শক্ত বুট পরে।

জীবন যায় খালি পায়ে।

 

মাঝখানে এতটা পথ— হিসেব করতে গেলে দু-ভাগ হয়ে যায়। একভাগ জল। একভাগ স্থল। জলে কুমির। ডাঙায় বাঘ। বাঘ-কুমির এক ঘাটে জল খায়।

 

জলের ওপর নাম জীবন!

 

কথাকে কি ফাঁস দেওয়া যায়? কথা যদি ঝুলে পড়ে? গলা তুলে রাখি। তারস্বরে চিৎকার করি, রাত ভাঙি... কথা ভারী হয়... কথার শরীর মাংস লাগে। কথা ভুলে যায় হারের বেদনা। এই কথা নিয়ে যখন ভাঙা রাত্রি কুড়োই সকালের দাঁত চকচক করে। সেই দাঁতে টুথব্রাশ ধরিয়ে দিই। সে ‘ওয়াক থু, ওয়াক থু' করে...

 

বাসি মুখে রাত্রি নিয়ে হৃষ্টপুষ্ট কথা নিয়ে দেখি— বারান্দার ঝোলানো দড়ি। তাতে ঝোলানো একটা ভেজা পাজামা আর একটা ভেজা ব্রা... কয়েকদিন ধরে পড়ে আছে... কিছুতেই শুকোচ্ছে না...

 

স্মৃতি জল ভরতে চায়। আমার কাছে জলের বোতল নেই। সে বলে: হাঁ কর। গিলে নে। জল কি গেলা যায়? জল পান করতে হয়। জল পান করব বলেই স্মৃতির কাছে হাঁটু মুড়ে বসেছি... হাঁটু ভেঙে গেছে৷ মালাইচাকি থেকে বেরিয়েছে রক্ত। জল লাল হয়েছে। জলে ডুবেছে গলা। সেই গলা আমি উঁচু করে মুখ বন্ধ রেখেছি।  মুখে জমে গেছে থুতু। লাল জলে সাদা থুতু ভাসছে। লাল-সাদা জল। চমৎকার দর্শনীয় জল। বোতল কই ভরব? জল পান করতে হয়!!!

 

যার ফিরে আসার কথা ভাবি— দেখি তার পায়ে জল! সে কি নদী পথে এসেছিল? গলা ডুবিয়েছিল জলে? ভেঙে যাওয়া নৌকায় কেটেছে কি তার পা? তার হাতে কেন বঁড়শি? মাছের শরীরে বহু আগেই সে পুঁতেছিল ঘৃণা.. পিচ্ছিলতা, আহা পিচ্ছিলতা কেন গোপন করোনি, অভিশাপসমূহ? জলের সাপ পেঁচিয়ে যায়... শীতকাল, ঘুম না-ভাঙুক... দূরে পড়ে থাক খোলস... ভেজা পা মাড়িয়ে গেলে কোনো হিস হিস শব্দ বেজে উঠবে না ঘরে...

 

যত শান্ত হয়েছে স্বর, চিরে গেছে গলা... চিৎকার ছাড়াও গলা চিরে যায় মাঝে মাঝে... মনে হয়— কোনো কুয়াশামাখা ভোরের পায়ে ঘুঙুর পরিয়ে আমিও হয়েছি মত্ত...  এই খসখসে গলায় আরও ঝরাতে হবে রক্ত। রক্ত যত বয়ে যাবে তাতে ভিজে যাবে গলা। হাড়কাঠ গলা থেকে পুটলি পুটলি কফ বাজাবে শিস। গলা থেকে যাবে। গলা চিরে যাবে। দূরের কোনো ট্রেন চিৎকার ছাড়াও থেমে যাবে, সিগন্যালের অভাবে...

 

একইভাবে বেঁচে আছি। তেষ্টা, তোমাকেও বলেনি— বাড়ি ফেরো। কলসির মায়া নিয়ে ডিসেম্বর দীর্ঘ হবে— এ-ভাবনা ভুল। জলের ওপর সর জমে। সরের লোভ শিশুকে উনুন অবধি পৌঁছে দেয়। তুমি আগুনকে ভয় পাচ্ছ! আগুন কি ডিসেম্বরকে ভয় পায়?

 

কুয়াশায় ভিজে যাও। শরীর থেকে বয়ে যায় নদী।

 

একইভাবে বেঁচে থাক। একইভাবে জলকেই বানিয়ে নাও ছুরি!

 

১০

একজন অন্ধ পাখি পড়ে আছে। সে উড়তে চায়। তাকে কি তুমি স্পর্শ দেবে? স্পর্শ পেলেই সে উড়ে যাবে। উড়তে উড়তে মাঝ আকাশে করে নেবে আত্মহত্যা৷

 

অন্ধ পাখিটিকে তুমি ডাকো। শস্য দাও। তার পালকের মধ্যে গুঁজে দাও বৃক্ষস্নেহ।

 

পাখিটি উড়বে।

 

পাখিটি অন্ধ ভেবে, খাঁচাটি বড়ো হল। শৌখিন হল৷ আকাশে উড়ে গেল কেবল মৃত পাখিগুলো...

 

১১

ঘোর কাটেনি। ঘর-ই কেটে হয়েছে দু-ভাগ। থাকার জায়গা বলতে উঠোন। সেখানেও ঝাঁট দাও। পাতা পড়ে। নিভে আসে আলো। সন্ধ্যার বুকে স্তন নেই। মাতৃত্ব আসবে— এমন ভোরে ডেকে যায় বাড়ির বেড়াল। পোষ্যর আকুতি কেউ কেউ মানে। যারা মানে না, তাদেরও কেটে গেছে ঘর।

 

ভোরের চাঁদ স্ফীত হয়। নুড়ে যায় কি শুধু চটে যাওয়া ঘোরের দেওয়াল?

 

১২

যে স্বপ্ন দেখতে চাই না, সেই স্বপ্নই দেখি। একই মৃতদেহ নিয়ে টানাটানি করছি। টানতে টানতে কখনো হাত খুলছি, কখনো পা, কখনো মাথা। মৃতদেহটি খিলখিল করে হাসে। কখনো বলে— সেলিম, তুমি টানাহ্যাঁচড়া না-করলে এ-শরীর শ্মশান অবধি পৌঁছাবে না। আমিও কি চাই ওই মৃতদেহ শ্মশান অবধি যাক? যাকে স্বপ্নের ভিতর লালন করছি, তার রাতের কোলে ঘুম পাড়ানোর দায়িত্ব কি আমার নয়? সন্ধ্যা হলে, রাত চাদর মেলে। স্বপ্ন এসে শুয়ে পড়ে। মৃতদেহটিও হয়ে ওঠে প্রফুল্ল... আমি তার নিম-চন্দনের সুবাস নিই। একটা শ্মশানকে দূরে ঠেলে আরেকটা শ্মশান জ্বালিয়ে নিই...

 

স  ম্পা  দ  ক  ম  ণ্ড  লী

তৃণা চক্রবর্তী

সুরজিৎ পোদ্দার

সুন্দরম দাস

bottom of page