এই মাসের কবি : রণজিৎ অধিকারী
আলাপ পর্ব
রণজিৎ অধিকারী ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় মুম্বই-এর "মায়ামেঘ" পত্রিকায় ২০০০ সালে। এযাবৎ প্রকাশিত কাব্যের সংখ্যা পাঁচ - প্রেম ও রাত্রির কবিতা (বাকপ্রতিমা, ২০০৬), আস্তাকুঁড়ের কবিতা (পাঠক, ২০১৬), উই পোকা ও নাক্ষত্র (দি সী বুক এজেন্সি, ২০১৬), অজাতসম্ভব (কবিতিকা, ২০১৬) এবং টেথিস সাগরের স্মৃতি (কবিতীর্থ, ২০১৮)। রণজিৎ অধিকারী সম্পাদিত পত্রিকা "পূর্ব"। সমাজ সংস্কৃতি বিষয়ক এই চিন্তাশীল পত্রিকাটি পনেরো বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে চলেছে। রণজিতের সাথে যোগাযোগ করতে হলে arjit1979@gmail.com এই ঠিকানায় মেইল করুন।
কবিতা
সেলাইমেশিন
এলোমেলো দিন,
তার খণ্ড উড়ছে এই... ওই
তার ওপর রৌদ্রখণ্ড পড়ে তাপ্পিমারা
রঙচঙে জামা
কোথায় সেলাইমেশিন — দিনবোনার শব্দ আসছে
মেঘের আড়াল থেকে
নদীর তলদেশ থেকে
পাহাড়ের বুক থেকে
কেউ কিছু জানে না শুধু সেলাই-এর শব্দ
দিন এলোমেলো, এলোমেলো উড়ে উড়ে
সেলাইমেশিনের দিকে যাচ্ছে
ভাব
রাতের সঙ্গে ভাব হয়
দিন এসে দাঁড়ায় অভাগী
নত হয়ে পায়ের আঙুলে মাটি খোঁড়ে
ছেঁড়া প্যান্ট জামা।
কীভাবে সে এসেছিল, কোনভাবে সে চলে যায়
টের পাই না।
দূরে ধুলো উড়লে ভাবি ওই যাচ্ছে কেউ।
বুকে কাঁপন লাগে
দিনে দিনে এই হয় — শুধু নিজেকেই
নাড়ি চাড়ি নাড়ি
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাব হয়
পৃথিবী একভাবে ঘুরতে ঘুরতে দিন যায়
দিন যায়।
তালগাছ
কোথা থেকে এনে প্রথম তালগাছের বীজ ফেলা হল।
আকাশ যেমন আছে তেমনই
ছিল আন্দ্রোমিদা আকাশগঙ্গার মতো আরো যারা
যথাযথ নামহীন।
বিস্তর আলোকহীনতার পর আলো-আঁধারি
কোটি কোটি দিন
তারপর কোথাও ক্ষীণানুক্ষীণ সম্ভাবনা
লম্বমান ছিল
তার বীজ হাওয়ায় ছিল।
আজ উচ্চশির তালগাছের
হাতছানির দিকে যেতে যেতে ভাবি ...
আকাশ যেমন আছে তেমনই
শুধু
কোথা থেকে এনে প্রথম তালগাছের বীজ ...
ধারণা, যা রূপ পেতে চায়
তারপর সূর্য সমগ্র স্থানে ছড়িয়ে পড়তে চেয়েছিল , কিন্তু
কখনোই সে সমুদ্রের তলদেশ স্পর্শ করেনি।
গহন অরণ্যের পায়ের কাছে আর তোমার শরীরের গভীরে
সে কখনোই ঝলমলিয়ে উঠতে পারেনি।
আমি যখনই তোমাকে ভালোবাসতে চেয়েছি —
ভেবেছি এই ভালোবাসা সূর্যের ছড়িয়ে পড়ার আগে হয়তো ছিল
কেবল একটা তির্যক রেখা, ত্রিকোণের ধারণা কিংবা
একটা স্পর্শক মাত্র —যা ছুঁয়ে থাকে শুধু ...
আমি যখনই তোমাকে আদর করতে থাকি —ঝিকমিক করে ওঠে ;
কোথা থেকে এসে সে আলো আমার অঙ্গ মাতিয়ে দেয় !
... ধারণা কীভাবে রূপ পায়? অপরূপ হয়?
কোটি কোটি বছরের দিকে তাকিয়ে থাকি,
মেঘের ফাঁকে ফাঁকে নক্ষত্রেরা ভেসে বেড়ায় ...
আমি আমাকে খুঁজে পাইনা,
তোমাকে দেখতে পাইনা —যেন সূর্যের ছড়িয়ে পড়ার আগের
দুই বিন্দুর ধারণা হয়ে আছি।
কোনপথে এতদূর এসে এই ভালোবাসায় ঝলমল করে উঠেছি আজ !
যে ভালোবাসা কখনোই আকাশ নক্ষত্রের বিস্তারকে স্পর্শ করতে পারেনি।
কীভাবে পড়তে হয় প্রেমে
কীভাবে প্রেমে পড়তে হয় তা কিন্তু সবার জানা উচিত।
কজনই বা জানে বরফ কীভাবে পড়ে ; অতি অল্পজনই দেখেছে —
খাদের দিকে পাথর গড়িয়ে পড়া।
শিশির পড়তে সত্যি সত্যি তো কেউ দেখেনি!
কেন মার্চেই প্রেমে পড়তে হয় কিংবা ভাদ্রমাসের দিকে
তা জানা জরুরি :
কেন নাম জানার আগেই পায়ের গড়ন দেখতে হয়, আর মেয়েটি
কেমন করে তাকায়।
আমরা তো জানি কীভাবে পাতা ঝরে আর দমকা বাতাস দেয়
মার্চে — সব এলোমেলো করে দেয়।
ভাদ্রের রাত্রিতে টিপটিপ বৃষ্টি — হঠাৎ করেই মনে হয় ঘর শূন্য,
শরীরে অভাব বোধ হয়, কী চায় ...
হাতে কড়া পড়ে যাওয়া কিংবা উঠোন জুড়ে শ্যাওলা পড়ার
কত আগেই মানুষ প্রেমে পড়েছিল — সব ভুলে যায়, একদিন
সব ভুলে যায়।
মার্চের পর মার্চ আসে, ভাদ্র, কত ভাদ্র... মানুষ প্রেমে পড়েনা আর।
ভিভালদি কিংবা আমরা
ভিভালদির ভায়োলিন কীভাবে একটা আস্ত শরৎকালকে
বাজিয়ে দিয়েছিল।
আমাদের চোখে দেখা শরৎ তো তার কাছে নস্য।
কীভাবে জ্যান্ত হয়ে ওঠে সব? — এই অভিলাষ আমি পেয়েছি
সেই ফকিরের কাছ থেকে যে সব ছেড়েছুড়ে দিয়েও
গোটাটাই ফিরে পেতে চায়!
ধরো, এক বিপুল ঝড়কে কবিতায় ঢুকিয়ে দিতে পারা কিংবা
শব্দগুলির প্রণয়িনীর মতো শীৎকার করে ওঠা ...
আমি শেষপর্যন্ত সেই অজ্ঞাতনামা স্রষ্টা যে ঘনিয়ে তোলে
একটা কালো মেঘ আর সে আস্ত মেঘকেই
কবিতায় রেখে দিতে চায় ; চাই একটা বিস্ফারণ
যা শব্দের শৃঙ্খলাকেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে।
আমি নয়তো অন্য কেউ তারপর আরো কেউ —এই জগৎকে
পুনরায় নির্মাণ করুক যেভাবে ভিভালদি তাঁর ভায়োলিনে
বসন্তকে প্রকৃতির চেয়েও আরো বেশি সত্য করে তুলেছেন।
জ্যামিতি বাক্স
কেননা সবচেয়ে জরুরি ছিল একটা বৃত্তের ধারণা তৈরি করা,
আর দলা পাকানো এক মণ্ডকে ঠিকঠাক গোল করে তোলা।
তখন কেই বা জানত ঘুরতে ঘুরতেই তারা সব
এক এক দাম্ভিক গ্রহ নক্ষত্র হয়ে উঠবে!
আজও যখনই কেউ একটা জ্যামিতি বাক্স হাতে নেয়, আমি
নতুন সম্ভাবনায় কেঁপে কেঁপে উঠি, যেন অযুত প্রাক্ -ধারণা
প্রস্তুত হতে থাকে। আবার নতুন নতুন ব্রহ্মাণ্ড তৈরির প্রক্রিয়া
যেন শুরু হবে এই এখুনিই, ওর হাতেই ...
কেননা এই সমূহ ব্রহ্মাণ্ড হয়ে ওঠার আগে ছিল মাপজোখের
সামান্য ক'টি ধারণা আর এক অলীক জ্যামিতি বাক্স!
কার হাতে ছিল!
কোত্থেকে এরা সব আসছে
যদি জানা না-থাকে, কোত্থেকে এরা সব আসছে ;
যেমন হাওয়া, -- মেয়েটি বলল যে, "আজ চমৎকার
আবহাওয়া' -- বলে খিলখিল হেসে উঠল।
একটা মথ কিংবা প্রজাপতির মতো কেউ হাওয়ায়
পাক খেতে খেতে পূর্বনির্ধারিত এক ঘূর্ণির ভেতর
বসন্ত এনে ফেলে, সে জানেওনা বসন্ত কী!
তবু আজ এই চমৎকার আবহাওয়া!
ভাবো কোত্থেকে এরা সব আসছে! -- আমি সেইসব
জিজ্ঞাসু যোনির কাছে গিয়ে চাক্ষুষ করি
আদি কম্পন কিংবা টানটান স্তনবৃন্তের মুখোমুখি
হয়ে পড়ি জরদগবের মতো
-- এরা সব কোথা থেকে আসে, -- হয়তো ভেবেছে
এই আবহাওয়াই
শেষমেশ বসন্ত এক আবহ, আর হাওয়ার ঘূর্ণির ভেতর
পাতারা খিলখিল হাসতে থাকে।
একটা অনুভূতি, যা আমরা কেউই জানি না
সে তখন একটা অনুভূতি খুঁজে বেড়ায় আর
পৃথিবী ধীরে ধীরে তার সীমানা মুছে দিতে থাকে ...
...। নগ্নতা কিংবা গাছপালার গন্ধ।...
প্রবেশের মুহূর্তেও মেয়েটি সেই অনুভূতিটি খুঁজে চলে
তারপর হারিয়ে যেতে থাকে।
চেতনা কী?
প্রথম স্খলনের পর পুরুষটি দাঁড়িয়ে থাকে ও
হাঁটু মুড়ে মেয়েটি স্বভাবতই যা পছন্দ করে সেভাবেই
অনুভূতিটা খুঁজতে থাকে। যেন অনেক দূর থেকে সে
ভাবে -- সত্যি বলতে তার জীবনে যেন কী একটা নেই !
... কিন্তু সম্পূর্ণ নগ্ন হওয়ার পরও একটা আড়াল, যা তারা
কখনো ঘোচাতে পারে না।
...। পুরুষটি আসন বদলে নেয়।...
দ্বিতীয় চরম মুহূর্তেও যখন ঝাপসা হয়ে এল সব -- তখনও
মেয়েটি টাটকা নিসর্গের গন্ধ পায়-- গাছপালা বন্য পোকামাকড়।
সে ডানা মেলে উড়বার চেষ্টা করে। কোনোভাবে
তার সামনের এই দেওয়ালটা ভেঙে ফেলা যেত না ?
জীর্ণ ত্রিভুজ কিংবা নিজস্ব জ্যামিতি
একটা ত্রিভুজ —ঝরে পড়ার আগে পর্যন্ত তিনটি কোণই
টিকিয়ে রাখে ; যেন জগতে তার এই জেদ —
সমূহ জীর্ণতার পর মৃত্যুকে অতিক্রম করার পূর্বমুহূর্তেও
তার কুঁচকে যাওয়া তিনটি বাহু আর
তোবড়ানো তিনটি কোণ।
মানুষ স্বভাবতই চেয়েছিল একটা ঢুকবার পথ,
একটা কোনো সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করে নিতে ...
প্রান্তগুলোকে আদর করতে করতে
কল্পিত সেই উচ্ছ্রিত বিন্দু তারপর পথ ভুলিয়ে দেয়।
মানুষ কেন কখনোই জ্যামিতির অর্থ বোঝেনি,
সে এই রহস্য ভেদ করতে পারেনি কখনোই —কেন কিছু
জ্যামিতিক ধারণাই জগৎকে পালটে দেয় বারবার!
কিংবা ছিল এক মহাজাগতিক খেলা —যা
সামান্য ক'টি ত্রিভুজ, চতুষ্কোণ, বহুভুজ ... গোলকের
সমাহারেই ঘনিয়ে তোলা!
খসে পড়ার আগে মৃত্যুর কাছে দাঁড়াই,
ব্যক্ত হওয়ার আগে সৃষ্টির কাছে দাঁড়াই ...
যা কিছু চলমান, যা কিছু ধ্বংসের পথে —
নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আগে আমি একটা শূন্যের থেকে
আরেকটা শূন্যের দিকে পা বাড়াই আর তখনও
একটা কুঞ্চিত রেখায় ঝুলতে থাকি।