এই মাসের কবি : প্রোজ্জ্বল পাল
আলাপ পর্ব
প্রোজ্জ্বল পাল (জন্ম ২রা মার্চ, ১৯৯৫) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণীবিদ্যায় স্নাতক। বাড়ি - আগরপাড়া। পেশা - শিক্ষকতা। নেশার মধ্যে লেখালিখি আর সিনেমা। কবিতা আর ছোটোগল্প লেখার দিকে ঝোঁক বেশি। লেখকের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম - praju.5972@gmail.com
কবিতা
১
যেসব সবুজ শীতকালীন রেলগাড়ি তোমার জন্য ছুটি আনতে গেছে অরণ্যদেশে -
তাদের বলে দিও আগামীকাল রোদ উঠবে জোর।
আগামীকাল হাওয়া দেবে উত্তুরে,
কমলালেবুর কোয়া মুখে নিয়ে হাসবে শিশুটি।
আগামীকাল খবরের কাগজের প্রথম পাতা পুরোটা জুড়ে বিজ্ঞাপন থাকবে না।
যেসব অগোছালো শব্দবন্ধ তোমার উদ্দেশ্যে নিবেদন করে আমি কবির ভেক ধরেছি -
তাদের বলে দিও তোমার এত স্তাবকতা পোষায় না।
তুমি শান্ত দিঘির পাশে চুপ করে দুপুরের মৃত্যু দেখবে বলে
তোমার চারপাশ ঘিরেছ অগম্য সুষুপ্তিতে।
আগামীকাল তোমার ঘুমের পাশে একটি ফুল ফুটবে দেখো,
সুগন্ধি ও অভিজাত।
আগামীকাল।
ধীর ও নরম পায়ে তোমার জন্য একটি সদ্যস্নাতা আগামীকাল আসছে দেখ।
২
মৃত বিদূষকের মাংস খেতে শকুন পাঠায় যে রাষ্ট্র -
আমি তার জন্য উৎসব করতে দেখেছি খুব মন দিয়ে গান শেখা যুবতীকে।
আমি অস্থির হাওয়ার রাতে দেখেছি নগ্ন ফুটপাথশিশু ঘুমোচ্ছে
গায়ে অলীক জোছ্নাচাদর।
তিনটে ছবি আঁকার পর পাগল হয়ে যাওয়া লোকটাকে আমি দেখেছি
ভিড়ের মধ্যে একটা মুখ খুঁজছে রোজ। রোজ। রোজ।
আমি বহুযুগ পুরোনো এক হত্যাকারীকে দেখেছি
শীতকাল এলে কেমন ছাল উঠতে থাকে সর্বাঙ্গে।
আমি বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক হতাশা দেখেছি কেমন
বিজ্ঞাপনের উল্টোদিকে লিখে রেখে গেছে -
'এই সভ্যতা কখনো আমাদের ছিল না।
এই সভ্যতা কখনো আমার ছিল না।
আমরা এই সভ্যতার কেউ নই।
আমাদের অসভ্য করে দাও হে সাম্যের দেবতা
অথবা সাম্যের অসুর।'
৩
তিনভাগে ভাগ করা বিকেল -
প্রথম দুভাগ যুবক যুবতীদের জন্য,
তারা গান করবে, স্বরচিত কবিতা পাঠ করবে,
কেউ একজন ছবি আঁকবে গানের সাথে সাথে।
তৃতীয় ভাগে থাকছে ম্যাজিক শো।
যাদুকর শূন্য থেকে নেমে আসবেন।
এসে চিৎকার করবেন,'আমি সব জানি।'
সমবেত দর্শক হেসে উঠবে।
যাদুকর আবার বলবেন,'আমি সব জানি!'
তারপর দর্শকদের একজনের পকেট থেকে একটা রক্তাক্ত ছুরি বের করে আনবেন।
দর্শক এবার চুপ।
যাদুকর আবার বলবেন,'আমি সব জানি!'
আর সেই মহিলার হ্যান্ডব্যাগ থেকে বেরোবে একটা বন্দুক। গুলিভরা।
সবাই ছিটকে যাবে।
ক্রমে যাদুকর এক এক জনের পকেট থেকে বের করে আনবেন -
প্রেয়সীর কাটা মুন্ডু, মৃত বাবার ছেঁড়া গেঞ্জি, বাতিল আতরদান, কাঁচা খিস্তি সমগ্র, লকলকে সেক্স টয়, নরম শিশুমাংস, আধপোড়া দলীয় পতাকা, বাসের টিকিট ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
যুবক যুবতীরা আর গান করবে না কারণ
দর্শক এখন সবাই একে অপরের দর্শক।
আর বিকেলের শেষভাগে যাদুকর খেলার পর খেলা দেখিয়েই যাবেন।
৪
তোমাকে দেখবে বলে বন্দর থেকে
এক দৌড়ে পানশালায় এসেছে তোমার গতজন্মের অন্ধ ভাস্কর্য।
শহরের মাঝ বরাবর মৃতের সারি,
নেশাতুর চাঁদ ভাবে এই সমস্ত আলোকমালা, উৎসবকাতুরে।
নিস্তব্ধ লোকালয়ে খেলনার দোকান পরপর,
যুদ্ধাস্ত্র কিনবে বলে ভিড় করে শৈশব।
বহুদিন অরণ্য দেখেনি কেউ এদেশে,
শুধু কবরের বিস্মৃতি চেনায় আগাছা।
তোমার প্রিয়তম জলাশয় - সে দানবীয় নিস্তব্ধতায়
কাঁপতে কাঁপতে ডুবে গেছে ভীরু জ্যোৎস্না।
শুধু আমি,
তোমার ফেলে আসা ভাস্কর্য, অসমাপ্ত ও চিরকালীন -
এখনো পাথরের খাঁজে ধরে রাখি বিক্ষত অশ্রুকণা।
৫
খাদ
- একটা চোর ভুল করে একদিন এক আয়না বিক্রেতার ঘরে ঢুকে পড়ল।
- তারপর?
- তারপর দেখল ঘরভর্তি অনেক চোর তাকিয়ে তার দিকে।
দোকান
- আর আয়নাবিক্রেতা?
- সে তখন নেশার ঘোরে গাছতলায়।
- আর চাঁদের আলো?
- তার-ই তো নেশা।
তরল
- নেশা কাটবে কখন?
- ততক্ষণে চোর তার সমস্ত লাল-নীল পাথর ভরে নিয়েছে ঝোলায়।
- আর কাঠের পাখিটা?
- সে তো সুযোগ বুঝে উড়েই গেল।
আদর
- চোর পাথর নিয়ে করবেটা কী?
- কিন্তু সে ব্যাটার ধুলোর শখ।
- পাথর ভাঙবে?
- আয়না জুড়ে।
৬
আবার কখনো তোমায় দেখব চলন্ত বাসের জানলায়।
ক্রমশ বিজ্ঞাপনে ছেয়ে যাওয়া এ শহরের ছায়া তোমার মুখে -
অথচ হিজিবিজি বাংলা ইংরেজি হিন্দী শব্দগুচ্ছ কেউ তোমায় একফোঁটাও বুঝতে পারছে না।
তুমি চলন্ত বাসের জানলায় একা।
ভোরবেলার মতো নিদাগ।
আমার খুব দ্রুত দৃশ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার বাতিক, জানো তুমি।
যেন জলের ওপর হেঁটে যাওয়া, যেন ঘুম না ভাঙে অলীক নীল মাছেদের।
(তোমার ওড়না জুড়ে মাছ আঁকা ছিল সেদিন)
তেমনি তোমার সমস্ত দৃশ্য, স্মৃতিবাসনা ও বাসের জানলা থেকে -
আমার এ পক্ষীজীবন নিয়ে সরে আসি আমি।
তুমি বাসের জানলা থেকে দেখ একটা পাখি ট্রামতার পেরিয়ে তোমার পরের কবিতার দিকে উড়ে গেল।
৭
দুবার দেখা হওয়ার কথা আমাদের।
প্রথমবার আমি উচাটনে, নোনা হাওয়ায় খোলা উইন্ডচিটার।
তুমি নির্মোহ। রং কিনতে এসেছ শীতল প্রার্থনাসভায়।
দ্বিতীয়বার আমি সাদা পর্দা, ছোট ল্যাম্পশেড।
তুমি চলতি পথে লিখে রাখার ছোট্ট ডায়েরী, সহজ খোঁপা।
আমি নেশা শিখতে এসেছি স্তাবকউৎসবে।
প্রথমবার বিদায়ের পর তুমি চড়াই পেরিয়ে ফিরবে তোমার বাড়ি।
আমি ফিরে আসব যেরকম কোলাহল ফেরে শহুরে রেল স্টেশনে।
দ্বিতীয়বার বিদায়ের পর তুমি চড়াই পেরিয়ে ফিরবে তোমার কাছে।
আমি ফিরে আসব যেমন নীরবতা ফেরে রাতের স্টেশনে।
যেরকম অপেক্ষা ফেরে জন্মান্তরের সান্ত্বনায়।
৮
শান্ত হয়ে বসে থাকা যায়।
আমার মাথার ভেতর সন্দেহ, মহাপুরুষদের বাণী এবং ঘুমের এঁটোকাটা।
এ বিস্তীর্ণ প্রান্তরে বিষাদফসল বুনে রেখে গেছে শীত।
পাথুরে হাওয়ার গায়ে নীরবতাচাদর জড়িয়ে রাখি,
যেমন করে ভালোবাসা রাখে দূরত্ব।
শান্ত হয়ে বসে থাকা যায়।
আমার সমস্ত ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়ার মানুষ নেই আর কেউ।
আমার সমস্ত প্রেম আমি বেচে দিয়ে এসেছি বাহারী কবিতামেলায়।
তবু তোমার সামনে সাজিয়ে রাখি ঔদ্ধত্য বা আত্মপ্রতারণা।
মাঝে মাঝে মনে হয় ভেঙে দিই এই শিকলসন্ন্যাস।
বিবর্ণ রাস্তাঘাট ধরে চলে যাই যেখানে ফিরব বলে বিকেল জেগে আছে -
যেখানে জানলাবন্দী চোখ এখনো শব্দ চায় আমার।
যেখানে নিভন্ত ফায়ারপ্লেসে তোমার মুখ দেখি প্রশ্নহীনা।
শান্ত হয়ে বসে থাকি তবু।
আমার এ আমি নিয়ে আমি যাব কোথায়!
৯
শূন্যতার অনুবাদ করতে গিয়ে আমি দেখি
রংচটা মেয়ে দাঁড়িয়ে বিদেশী সৈকতে,
তার চোখে আরো সঙ্গীহীন জাহাজ
যাকে এইমাত্র উপমা হিসেবে রেখেছে
তার প্রেমিক ও প্রতারক।
মুহূর্তের অনুবাদ করতে গিয়ে আমি দেখি
ক্যামেরা হাতে মেয়েটি বলছে,'ছবি তোলার আগের ও পরের মানুষটি আলাদা।'
শুধু খালি পায়ে ভেঙে আসা রাস্তাপাথর এক।
ভালোবাসার অনুবাদ করতে গিয়ে আমি দেখি
শিল্পীর একদম গভীরে একজন নেশাখোর। অপরিণামদর্শি। ধ্বংসলোলুপ।
অনুবাদ হয় না শূন্যতা, এ নিবিড় নিঃসঙ্গ প্রেমহীন আঁকড়ে ধরা বিষণ্ণ শৈত্য।
শুধু সমুদ্র বারবার অনূদিত হয় মানুষে।
১০
আজ থেকে বহু শতাব্দি আগে ও পরে,
ভালোবাসার সাথে হিংস্রতাকে গুলিয়ে ফেলেছিলাম আমি।
তাই তোমার কথামতো এনে দিয়েছিলাম তোমার প্রিয়তম জন্তুর মাংস।
তার তরুনীরক্ত পড়েছিল মাটিতে। এদেশে সে মাটিও রুক্ষ, শোণিতভোজী।
তোমাকে ওরা শিখিয়েছিল ভালোবাসা আর হত্যা এক জিনিস।
তোমার মধ্যে যে যে আবেদন দেখতে পেতাম আমি সে সমস্ত আসলে যুদ্ধাস্ত্র।
তোমার চিঠির ভাঁজে সমস্ত স্বপ্ন ছিল, তুমিও জানো সে সমস্ত আসলে যুদ্ধ সম্পর্কিত ভুল ধারণা (যেমন - শান্তি)।
তোমায় আর আমায় ওরা শিখিয়েছিল অরণ্য আর সভ্যতা আসলে আলাদা।
শহরে মানুষ মানুষের মাংস খায় না।
অথচ
তোমার আর আমার যতবার দেখা হয়েছে রক্তলোলুপ শ্বাপদের সাথে, প্রতিবার আমরা শহরে ছিলাম।
ওরা আমাদের শিখিয়েছে ভালোবাসা কিভাবে হবে।
তার পণ্য, নিয়ম ও বেনিয়ম কি।
যেভাবে ওরা আমাদের ডান পা, বাম হাত, নাকের গড়ন কিম্বা পোশাকের রং ঠিক করে।
শুধু অপেক্ষা ও মৃত্যুর পার্থক্য ওরা আমাদের শেখাতে পারেনি বলে আজ আমি নিরুদ্দেশ, তুমি মৃত্যুহীন।