এই মাসের কবি : প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী
আলাপ পর্ব
জন্ম আসামের করিমগঞ্জে। কর্মসূত্রে কোলকাতায় আসা। কর্পোরেটে চাকরী করেন পি আর, এডভার্টাইজিং-এ। মাস কম্যুনিকেশন জার্নালিজম নিয়ে পড়াশুনা। মূলত কবিতা লেখেন, টুকটাক ব্যক্তিগত গদ্যের পাশাপাশি। প্রথম কবিতার বই ‘বানানো সংলাপ’ প্রকাশিত হয় যাপনচিত্র প্রকাশনা থেকে। যাপনচিত্র, এই সময়, দেশ, যুগশঙ্খ, সম্পূর্ণা, নতুন কৃত্তিবাস, সানন্দা ব্লগ, কবিতাআশ্রম, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, মহুল, জাগরণীয়ার মতো বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালিখি করেন। প্রিয়াঙ্কার সাথে যোগাযোগ করতে হলে মেল করুন priyanka.puja@gmail.com এই ঠিকানায়।
কবিতা
পাঠিকা
ছুরির মতো ধারালো কিংবা আগুনের মত উত্তপ্ত কবিতা গুলো পড়ে
শিউরে ওঠাও এক জ্বালাতন।
অভ্যাসবশত নাছোড় ইচ্ছে চেপে বসবে
অথচ তোমাকে পাঠাতে পারবো না।
কারণ তুমি বলবে, তোমার পাঠিকা চুরি হয়েছে।
আমার মনে প্রশ্ন জাগবে ‘আমি কি এতই পল্কা যে সহজেই চুরি হতে পারি?’
খানিকটা গর্ব হবে ‘আমি কি এত দামী যে সহসা চুরিও যেতে পারি?’
সন্দেহ হবে ‘আমার দৃঢ়তা সম্পর্কে তুমি এত কম জানো যে ভাবলে আমিও চুরি হয়ে যেতে পারি?’
শেষে অভিমান হবে ‘আমি কি তোমার পাঠিকা শুধু? শুধুই পাঠিকা তোমার?’
নক্ষত্র
যে রাস্তা সঙ্গে নিয়ে গেছো, যে রাস্তা কুন্ঠাতেই ঢাকা
দেখোতো জলের পাশে গিয়ে ছায়া পড়ে নিস্তব্ধ নিবিড়
কারা এসেছিল এর আগে। বসেছিল, হেঁটেছিল খানিক
পায়ে পায়ে জঞ্জাল সরিয়ে, অন্ধকার সন্ধ্যায় শিবির
পেতেছিল গাছের কোটরে
দোচেলু পাখির সাথে সাথে, জেগেছিল মিলনান্ত রাত্রি
পাশাপাশি সব নিভে এলে, জোর করে বুজেছিল চোখ
ঘুম ফেলে এসেছে জানেনা, দীর্ঘদিন প্রস্তুতিবিহীন
সে অবশ্য অন্য প্রেক্ষাপট। অন্য স্থান, অন্য পাত্র,কাল
রহস্যের মতই আঁধার । থাক বন্ধ থাক।
এভাবেই হাতে হাতে ঘোরে। অন্তরীক্ষ, স্থল আর জল
সৌধ থেকে অরণ্যে বসতি, বাস্তু থেকে দীর্ণ অবস্থান
এভাবেই চিহ্ন থেকে যায়, কিছুটা আগের, কিছু নতুন
আর যাপনের ভাঁজে ভাঁজে, জেগে থাকে নিভৃতে স্বীকৃতি
সন্ধে
সন্ধে নেমে আসে।
ডোবার সবুজে নামে, কচুরিপানায়...
আমার শরীরে নামে মজ্জায় মজ্জায়
ধীর নামে চারিদিক স্তব্ধ হয়ে এলে,
কয়েকটা পাথর শুধু শূন্যে চেয়ে থাকে
এমনই নিস্তব্ধ সন্ধে কানে কানে ডাকে।
এরই মাঝে ভ্রম হয় চোখের পাতায়
জোনাকির আলো আর কে নেভাতে চায়!
ভ্রম হয়, দিনগত পাপক্ষয় হলে
নিজের ভেতর থেকে অন্তরাত্মা বলে –
কী কারণে কাঁপে ঠোঁট, কীসে এত ভয়!
এমনই নির্জন হোক একান্ত সঞ্চয়।
জ্বর
ঝড়ের পরবর্তী জ্বরের কারণ কে তুমি শৈল্পিক হাতে যতই ঢাকো
যতই দমকা হাওয়ার মত ধমকাও
চিরায়ত অবাধ্যতা ভুলে গিয়ে তোমার কথায় মন্ত্রমুগ্ধ
ওষুধ গিলি, বন্ধ করি আচমকা ফোন
লিখতে বসি। আলস্য কে তাকিয়ে দেখি অবাক চোখে।
রোদের মতো এদিক ওদিক জানলা গলে এগিয়ে আসে। ঢুকতে দিই না।
বসতেও নয়।
বসব শুধু আমরা দু’জন। শব্দ পেতে। মেঝের ওপর।
দু’এক ফালি কিচির মিচির আনবে তুমি সঙ্গে করে
ফেলবে আমার গায়ের ওপর, ঝেড়েও দেবে আলগা হাতে
বিকেল হলে ফিরেও যাবে।
নির্জনতার মোহের সাথে পাল্লা দিয়ে আবার আমি পা বাড়াব
একলা হাঁটার রাস্তা ধরে।
হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে যাব অনন্ত পথ...
অপেক্ষমান আবার হব। অনন্তকাল।
শালিক পাখি, তোমার কথা শুনব বলে।
বুদ্ধ পূর্ণিমা
জনপদ, কোলাহল পেছনে সামনে রেখে
জলের ভীষণ কাছে নতজানু বসি
নুয়ে পড়া গাছ আর ছুঁয়ে থাকা কবিতার ভেতর দৃশ্যতই পূর্ণিমা আলো
চমকে দেখেছি সেই আলোতেই বোধিপ্রাপ্ত দু’হাত তোমার
বলা ভাল, যা দেখেছি বর্ণনাতীত
বুদ্ধ পূর্ণিমার রাতে চন্দ্রাহতের মতো গুলিয়ে দিয়েছে যা সমস্ত অতীত
শামুকতল
ট্রেনের লোয়ার বার্থ । প্রকৃতি চলচ্চিত্রময়।
বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠে কিংবা ধানের ক্ষেতে
আল ধরে ছোট ছেলে মেয়েদের দল।
জানালায় একে একে সেতু পার হওয়া
ভাঁড়ের চায়ের মতো তরল আবেগ
সমস্ত নিবিড় করে কয়েক ঘন্টার জন্য ঘরে বেঁধে ফেলা।
আঁধার নামলে পরে সন্ধের শেষে
শামুকতলের মতো অনামি স্টেশনে নেমে যাওয়ার কথা
কোনও একদিন সকলেরই মনে হয়।
একবার
ঘেমেছ কপাল জুড়ে, এই শীতে, এই শীতকালেও।
মুছেছো আহ্লাদ করে যেমন মুছেছো সাদা কালো
অক্ষর, প্রমাণ সহ যাবতীয় ধারাবাহিকতা –
অতন্দ্র রাতের দিকে জোনাকি যেমন যায়, হঠাৎ!
সরিয়ে রেখেছি তাই শব্দ, অর্থপূর্ন, অর্থহীন
বাড়িয়ে রেখেছি পা তীব্র অনিচ্ছায়
পেছন ফিরেছি প্রায় এক লক্ষ বার।
সে যদি দাঁড়ায়, এসে একবারও দাঁড়ায়!
স্বেচ্ছায় দাঁড়ায় যদি, কিংবা অপেক্ষায়?
ধার
আমাকে নিস্তব্ধ করে যেসব সবুজ ঘাস
কিংবা কোনো রাতের জোনাকি
তাদের শরীর থেকে ধার করে সতেজতা আনি
ধার করে জ্বলে নিভে থাকি ।
লক্ষ বছর থেকে একেকটা দিন যদি বাদ পড়ে যায়,
তাতে লক্ষাধিক মানুষের কিছু আসে যায়?
তবে ধার করি একেকটা মুহূর্ত
আর ধরে রাখি, যতক্ষণ ধরে রাখা যায়...
অকৃপণ যত্ন নিয়ে সমগ্র সত্তায়।
শ্রোতা
নিজেই বলব বলে নিজের মনের কথা
এখানে ওখানে ঘুরে, রোদ মেখে, ছায়া ঢেকে এই এসে বসি...
শ্রোতা নেই। সকলেই বধির তোমার মতো।
সেই থেকে চুপ থাকা আয়ত্তে এনেছি।
মন্থর দিনের মতো ধীরে হেঁটে পৌছেছি
ব্রহ্মপুত্রের কাছে...
যেখানে জলের শব্দ তড়িৎ গতিতে নামে
স্পষ্ট শোনায় তাল, গেয়েও দেখেছি
মিয়াঁ কি টোড়ি কিংবা আহির ভৈরব
ব্রহ্মও জলের কাছে, নিষাদেই বাঁধা আছে।
বিষাদের কাছে মন অযথা নির্ভর
দেখি তো, কী মানচিত্র, কাকে ছুঁই কাকে রাখি
কাকে ফেলি কাকে দিই ক্লান্ত এ’শরীর
জলের স্পষ্টতা জেনে, কাছে গিয়ে মৃদু মৃদু গুঞ্জনে বলেছি
‘হাত রাখি? রাখি হাত?’ নিস্তরঙ্গ বয়ে যাবে কিছুটা সময়
আর এটুকু শেখার ছিল, কী করে অনেক কিছু যেতে দিতে হয়...
লামাহাটা
ততক্ষণে ভোর হয়ে গেছে, ততক্ষণেই রাস্তায়
খানিক ঠাহর করা যায়, ঘন কুয়াশায় চাদরে
বহুদূর গামী চোখ পড়ে যায় চুপ করে থাকা পাইনের
সারি সারি বেঁধে অদূরে দাঁড়ানো, নেই আমি কোত্থাও নেই
এগিয়ে যাচ্ছে আমার হৃদয়, মেঘ ঢুকে আসে সহজেই
ফোঁটা ফোঁটা গলে পড়ছে বাইরে, ফেলে ফেলে যাওয়া স্পর্শে
চরাচর জুড়ে শব্দহীনতা, দিগন্ত জোড়া স্পন্দন
হয় আমি সর্বত্রই আছি, নয় আমি কোত্থাও নেই!