এই মাসের কবি : প্রবুদ্ধ ঘোষ
আলাপ পর্ব
প্রবুদ্ধ ঘোষ উত্তর কলকাতার বাসিন্দা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে স্নাতকোত্তরের পরে বর্তমানে ওই বিভাগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও শিক্ষকতারত-গবেষক (টিচিং-ফেলো)। দাবা-প্রশিক্ষক। কবি ও প্রাবন্ধিক। এবং অবরেশবরে গল্প-লিখিয়ে। বিভিন্ন পত্রিকা ও ওয়েবজিনে নিয়মিত লেখেন। রাজনৈতিক সাহিত্য ও সাহিত্যের রাজনীতি বিশেষ আগ্রহের বিষয়। কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি জার্নালে। একটি কবিতার বই, 'যখন সংবিধান বদলে যাচ্ছে' ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়েছে যাপনচিত্র ফাউন্ডেশন থেকে। সাহিত্য ছাড়াও দাবা, রাজনীতি এবং মানুষের প্রতি অফুরান ভালবাসা। প্রবুদ্ধের সাথে যোগাযোগ করতে হলে মেল করুন এই ঠিকানায় jishnughosh2007@gmail.com
কবিতা
হেমন্তের রাতের দিকে গড়িয়ে যাওয়া কিছু
যাদের ডাকনাম স্মৃতিতে বেভুল
আশ্চর্য কবিতার মতো ভোর-
প্রতি মুহূর্তে আখরঋণ বাড়ে, অথচ-
প্রতিটি মুহূর্তই ছেড়ে যাচ্ছে নিজের তাগিদে
আশ্চর্য কবিতায় শব্দ থাকে না কোনও
স্মৃতিপতনের ছন্দে ধুয়ে যায় মাত্রাবোধও
সেসব স্মৃতিই কবে জাগিয়ে তুলেছিল ঘুমে
খোয়াবের একঘেয়ে পথে-
উপমার মতো অপেক্ষায় ছিল বেভুল চৌকাঠ
ঘরের শোকে, আকাশপ্রদীপ নিবিয়ে রেখে
চলে যাচ্ছে যে অবিন্যস্ত সযত্নপ্রলাপ
ওর ডাকনাম নেই?
আশ্চর্য কবিতার মতো ভোর-
ওকে ডাকো
শরিকিবাড়িতে আতসবাজির শেষে
ছাতিমের গন্ধ ঘিরে বসনতুবড়ি জ্বালে
শরিকিবাড়ির মৃদু কিশোর।
ওটুকু বারুদকথা তার। রঙমশালের সোহাগী আলোয়
পরীকে অপেক্ষায় পাবে, ভাবে।
ওদিকে বলির ঢাক। পোড়ে সমিধ বেলকাঠ।
হুহু যজ্ঞের ভাপ দুঃখ পোড়ায়?
প্রোমোটার আনে, পরী, যুদ্ধের স্তোত্রপাঠ?
যতক্ষণ ফুলঝুড়ি আলো ক’রে রাখে দারিদ্রসীমা
ততক্ষণে হেমন্ত শোক দেয় আকাশপ্রদীপে।
বারুদ, স্তোত্রপাঠ বিষাদছাতিমে শান্ত হয়ে এলে
কয়েকটি ভূতের সাথে আলাপচারিতা।
প্রোমোটারি চুক্তিসই সেরে
দেড়-কামরা ফেলে যেতে যেতে কিশোরটি ভাবে-
কারা এই অন্ধকারে পথ চিনে পৃথিবীতে আসে?
মানচিত্রে কাঁটাতার শুধু
মৌন ভাতের থেকে কিছুটা দূরত্বে নুন
জলের টানে টানে গড়িয়ে এসেছে ব্যঞ্জন
চাঁদ মাথায় ক’রে জনপদ হেঁটে চলেছে বৃহত্তর
শহরের পথে; একটা ছেঁড়াফাটা মানচিত্রে ঢুকে
পড়ছে কতো জ্যামিতি। ফৌজি পোশাক ছিঁড়ে বেরিয়ে
আসছে মণিপুরের রক্ত
ফৌজি বুটের ভেতর ঘাস হয়ে জন্মায় কাশ্মীরের
আজাদি স্লোগান
দেশের ভেতরে বাইরে কাঁটাতারের খরচ বাড়ছে
দেশের ভেতরে বাইরে মৌলিক চাহিদা বাড়ছে
ভাত ভাঙ্গার স্বরবৃত্ত ছন্দে চুপ করে গেছে কারুবাসনা
পক্ষান্তরের দৈনন্দিনে চাঁদ ভুলে গেছে কারুবাসনা
এলোমেলো সরলরেখায় তবু একটা অগোছালো ঘর।
বাইরে আগুন।
প্রতিটি ত্রস্ত যাপনের দিনে
প্রতিটি শব্দের কিছু অভিমান আছে
প্রতিটি বাক্যে কিছু অনিবার্য শূন্য
সেইখানে গিরিখাত, সেইখানে নদী
সেইসব অমোঘ মনস্তাপ, না-পাওয়ার।
আরো কিছু বাক্য জড়ো হলে
অন্ধকার ঘনীভূত, মরণাপন্ন বিকেল
ছায়া পড়েনা, গম্ভীর মেঘে বৃষ্টি হয়না।
এসব আবহে অসমীচীন শুক-সারি
রূপকথা বল্মীকে ঘেরা।
যুদ্ধবৃত্ত পরিধি বাড়ায়, সাইরেন আচমকা
যে যার গর্তে, খুদকুঁড়ো ঠোটে
চুম্বনে তখন সন্ত্রস্ত নিরাপত্তা
অসংযত যতি শব্দবন্ধে যাপনপ্রয়াস
প্রতিটি গদ্যের ব্যক্তিগত কবিতা থাকে কিছু
প্রতিটি ন্যাড়াপোড়ার পর দাউদাউ বসন্ত
সেই লোকটার খোঁজে
পালিয়েই তো আসছি, বলো? সেই চিড়বিড়ে রোদ আর সূর্যগ্রহণের আবছা সকাল থেকে। পুণ্যহীন বয়সে
ফড়িংয়ের ডানাছেঁড়া অদ্ভুত বিকেল থেকে। ভার্সিটির ইকোনমিক্স ক্লাস থেকে ছিঁড়ে আনা অসুখী ক্যালকুলাস
ভ্যান গখের কানের মতোই বাতিল করেছিলুম। নস্ট্যালজিয়ার গায়ে ধুত্তোর আর প্রমোটারের হাতে বাড়ি ছেড়ে
পালিয়ে এসেছিলুম দু-কামরার ভাড়া বাড়িতে। পালাচ্ছিলুম দিকবিদিক অপাত্রে ঢালতে ঢালতে নিজেকে ভাঙতে
ভাঙতে। নিজের থেকেও পালাচ্ছিলুম কোনও এক আস্ত ভোরের স্বপ্নে রোম্যান্টিক চাঁদ যেমন গড়িয়ে গড়িয়ে
পালিয়ে যায়।
পালিয়েই তো আসছি, বলো! ডানাছেঁড়া ফড়িংয়ের ছটফটানো মুহূর্তের মতো। ধারালো আক্ষেপের ব্লেড
আর উৎসুক কব্জির দূরত্বের মতো। রোম্যান্টিক শব্দের কিছুতেই কবিতা না-হওয়া বিষাদের মতো। পালিয়েই তো আসছিলুম
সেই লোকটার খোঁজে
যে লোকটা ইমেজ বানাত। বেঁচে থাকার লোভে
সংকট ফুরোয় নি তাই
অন্ধনদীর পাশে বসে থাকি আহতকথন নিয়ে
চেয়ে নিই ক্ষতের আরাম, স্মৃতিবিভ্রম
সেইসব মুহূর্ত, যারা একা রেখে, মুছে গেছে
সেইসব মানুষেরা, যারা ফেরেনি, কথা নিতে
তাদের জটিল স্মৃতি খুলে রাখি বহমান জলে।
অন্ধ নদীর কাছে সাঁকো চেয়ে নিই
নিভৃত যাতায়াতের অলীক খোয়াব
ভেঙে পড়া সব জলযান, খাঁখাঁ বন্দরের চুপ
জেগে আছে বিষাদকিনারে, পারাপারহীন।
রিপু জুড়ে জুড়ে সাঁকো, ভরে ওঠে দিন
প্রগাঢ় সন্ধেয় দেওয়াল চিনে চিনে নিয়মমাফিক
সাজানো আলোর ঝোঁকে জনপদ ঘরে ফেরে
উৎসব বদলে যায় আকাশপ্রদীপে, হিম চুঁয়ে-
সিসিফাস জানে, সংকট ফুরোয় নি কখনও তাই
অন্ধনদীর জলে জেগে আছে ভাসানপ্রতিমা
মেঘ তাড়ানোর অনন্ত শোলোক
(‘খোয়াবনামা’-র তমিজের বাপকে)
পরিযায়ী শ্রমিকের বিপন্নতার মতো মেঘ
বৃষ্টিহীন অন্ধকার জমিয়ে জমিয়ে
প্রত্যাখ্যাত অঘ্রাণ জুড়ে পারাপার করে
যুগান্ত পেরিয়েও এইসব মেঘেদের রঙ
কোনও চাতককে শান্তি দিল না।
ঘরে ফেরার আলো নিবিয়ে দিল
ঝুলিয়ে রাখল বিষাদমুকুট গাছে গাছে
কেড়ে নিল প্রিয়স্বর শাসক-আদেশে
দশক-শতকভর মেঘ তাড়াতে তাড়াতে
তমিজের বাপ দেখে-
অঘ্রাণের দেশ জুড়ে হলুদ পাতারা
কবেকার শোলোকের স্বর রোদে দিল
রাত বেড়ে যাওয়া দিনগুলিতে
আলোর মহড়া জুড়ে ছায়ানাচ চলে
যুদ্ধআঁচে ঘন হয় দেশের লবণস্বাদ
জাতীয়সঙ্গীত জুড়ে গাঢ় উৎসাহে
উস্কোয় মেধযজ্ঞ, জ্বলে জনপদ
বন্ধুর পদবীতে রক্তছিটে
বন্ধুর ঠোঁটে ত্রস্ত অভিশাপ
শাসক থিতু হয় আমাদের মাথার ভিতর
আলোর মহড়ায় নাচে ধর্মনিষাদ
সাংবিধানিক ব্যথা কুড়ে কুড়ে খায়
এখানে কি ভোর কোনও গল্পের মতো?
এখনও কি ভোর হয় প্রাচীন কবিতায়?
দীর্ঘ হেমন্তের সন্ধেয় আজ
সরকারি জল্লাদ গেলাচ্ছে সিডেটিভ আর,
ফ্যাসিস্ট শাসক আঁকে দেশের কোলাজ
ভাসানের সন্ধেয় প্রার্থনা
উথলে ওঠা দারিদ্রের মতো বাটির দুধে
ফুঁ দিচ্ছে বুড়োর বৌ
শান্ত করছে আগুন।
দেবী তখন কিছুটা সঙ্কট মণ্ডপে ফেলে
হেমন্তের দিকে যাচ্ছে সন্ধে ঘনিয়ে
হাতে দুলছে বুড়োর রেলে-কাটা গলা
গলা অবধি ঋণ- পাশে পাসবই ডেবিটমসৃণ।
ব্যাগ থেকে কানা বেগুন ধ্বসা টমেটো
ছড়িয়ে পড়েছিল নৈবেদ্যর মতো।
সামান্য রংমশাল আলো ক’রে তোলে অভিমান;
চকচকে মুন্ডমালা। বর্ণমালা পেরিয়ে
বুড়োর ছেলে ছুটছে ভাসানের টানে।
চৌকাঠ পেরনো অনন্ত ক্ষিধেমুখ গাঢ় হলে
বুড়োর বৌ
আগুন শান্ত করার মন্ত্র চেয়ে নেয়
নির্বাসনে যেতে যেতে
এই যে ডিপ্রেশন, এই যে কোমল নির্বাসন
এসব ছাড়িয়ে কোনও গাছকে ঈর্ষা হয় খুব
এই যে স্থির হয়ে পরপর পাথর-আঘাত
আকর্ণ হাসিতে সয়ে বুকেতে জমানো
এসব ছড়িয়ে ফেলে নদীকে ঈর্ষা হয়
মানুষের কাছে আর ফিরে গিয়ে গাছ পাব? নদী?
শহরের কাছে ফিরে পুরনো সাঁতার পাব?
সেইসব চলাচল, কথা ছুঁয়ে ঠোঁটে ফেরা
ঠোঁটে ফিরে শব্দেরা বৃষ্টি নামাত, সেইসব যদি
না পাই বাইরে-ঘরে তোমাদের সমস্বরে
তখনই তো ভয় হয়, তখনই সরলরেখা
তোমাকেও ঈর্ষা করি।
নিজেকে জাগিয়ে রাখা, নিজেকে ছিঁড়েখুড়ে
চারদিকে ছিটিয়ে রাখা দিনমান
যুদ্ধের অবিরত অদৃশ্য রক্তদাগ মুছে
বাধ্যত সিটবেল্ট, লক্ষ্যমুখী পরের উড়ান
প্রিয় অবসর, স্বপ্নের সাথে যুঝে
সময়গ্রন্থি, এই নিরাময়হীন ক্ষতকথা
গাঢ় সন্ধেনামা ভাষাহীন বিস্বাদ দেয়ালজুড়ে
যক্ষ ভাল নেই; নির্বাসনে বার্তাহীন পুড়ে।
তোমাকে ঈর্ষা হয় সুসময়,
কবে ফের এই মন্ত্রে জীবন নিকোব?
‘মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ...’