কে কাকে স্বপ্নে দেখে?
স্বপ্নে আমি জল পেরিয়ে এসেছি গতকাল
এখানে ধূ ধূ বালি, হাওয়ার চিরুণি তল্লাশির পর
চেড়া চেড়া পাঁজর থেকে উঠে আসছে নীল হলাহল
আমার মতো আমি যাদের দেখি তাদের চোখে এক শতাব্দীর ঘুম লেগে আছে
তারা বালির নিঃসঙ্গ বুকের 'পর উপুর হয়ে শুয়ে অনুভব করতে চাইছে ঋতুবতী গাছের কোনো জন্ম।
আশ্চর্য চুপচাপ দশদিক, শব্দহীন অনিবার কান্নার শুভ্রতায়
বালিতে বালিতে ভেসে উঠছে স্তনমুখ আর
তার চারপাশে কক্ষপথের বৃত্ত সম্পন্ন করে অপেক্ষারত মৃত্যুর জন্য
দিন-রাত অসংখ্য নক্ষত্র; তারামণ্ডল,
প্রহর গুনতে গুনতে ঝরে পড়ে সাদা ফুলের নির্মাল্য নিয়ে
ইতস্তত ঘোর জাগে, দাঁড় ভাঙা শুক্লপক্ষের অলীক ঢেউ
এখানে এমনই নির্বাসন!
আমার স্নায়ুশূলে সত্তায় ফ্যাকাশে ভোরের পালক উড়ে বসে
ম্লান প্রেম; সুপ্তোত্থিতা
সংকোচে নিঃসংকোচে তুমি বলেছিলে অনেক কথা
পরলোকের পাথেয় চাই, অগ্নিদাহ থেকে শান্তি
অথচ গান্ধর্ব মতে আগুনের সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না আমার।
আমি এই সাদা ফুলের শিশির উজ্জ্বলতা দিয়ে ধুয়ে দেবো
তোমার পা পাতা মূল, পদপল্লব
তারপর বিস্তৃত পথ, কে কাকে স্বপ্নে দেখে?
তুমি তো চেয়েছিলে এভাবে
বড়ো হতে হতে যেন আকাশের মূর্ধা ছুঁয়ে থাকতে পারো আজীবন।
নিঃসঙ্গতা
১
আমার একটা ছোট ঘর
বিশেষ কিছুই নেই
কেবল বুকভর্তি নিঃসঙ্গতা
সেখানেই ডুবে যাই, ভেসে বেড়াই
দিন যায় রাত আসে
সাঁতার জানার উপকারিতা এখানে কিছু নেই
এখানে জোয়ার-ভাঁটা নেই চাঁদের নিয়মে
তুমি যেদিনই আসো
তুমি এলে ভেসে উঠবো একবার
এখনি কথা বলো না
আমি জিরাফের মতো মাথা তুলে, জিরাফের ভাষায়
তোমাকে বোঝাবো আকাশে অযুত জ্যোতিষ্কলোক আর
আমাদের অজানা নিঃসঙ্গতা।
আগুন একমাত্র প্রিয়
তুমি নিজ হাতে আজ আগুন নামিয়ে রাখো
কাঁদো কাঁদো, এমন করে কাঁদো
যেন বিষাদপৃষ্ট তোমার ওই নীল মুখ জ্বলে ওঠে,
জ্বলে ওঠে রক্তাক্ত দক্ষিণা
তুমি চেয়ে দেখো আমাদের যৌথ উঠোনে সমাপিকা ভোর
তারারা আলোর বীজ বপন করে বন্ধ্যা বাগিচায়
'ঝরে পড়ো, ঝরে পড়ো' বলতে বলতে খেলে যায় হাওয়া
আর আমার অনামিকা তার আজীবনের ভার বহন করে।
কে শেখালো তোমায় এমন গান, বেদনা, ক্রন্দন
লোভ হয় ছুঁয়ে দেখি,
মুহূর্তে যেন স্ফটিক ছড়িয়ে পড়ে অব্যবহিত ঈশান কোণে
আর কতদূর?
অপেক্ষা করো, এভাবে আর কারুর কাছে পৌঁছানো যায় না
তোমার শিরা শিকর দিয়ে ধরে রাখো মাটি, বনস্পতি
তুমি একাকিনী, তবে আমিও কি নই!
আমি বলবো অপব্যয় ক'রো না ঘুম, এবং ভিতরে সমুদ্রস্বপ্ন
মাঝ সমুদ্রের ঠিক কোন দিকে ভেসে যাই, দাঁড়ের শব্দ ছলাৎ ছলাৎ
সমর্পিত জলের লহরীতে যদি ফিরতে পারি সেদিন
হয়তো জীবিত শঙ্খ এনে দেবো তোমাকে
তুমি নিজ হাতে আজ আগুন নামিয়ে রাখো
গান গাও
যেন প্রগাঢ় অনুভবে, ভেজা শিশু উপত্যকায়,
প্রচ্ছন্ন নিকষ অন্ধ গহ্বরে কিংবা অন্য কোনোখানে
ঘুরে বেড়ায় এক নির্লিপ্ত ধূসর মেঘ।
চাকা
(দিঁজা ফর্মের একটি কবিতা)
পাখির নীড়ের মতো চোখে
পেয়েছিল শেষ ঘুম কারা
দ্বাদশী জোৎস্না গায়ে মেখে
নিঝুম বসে আছে কি? তারা
অপেক্ষায়, তবু নেই সাড়া
মৃদু কথা এবং বিস্ময়
ছুঁয়ে তাদের শরীরময়
চারিদিক সুদর্শন তিথি
তাতে নিভন্ত অগ্নি বলয়
পায়ে হেঁটে পার করে নদী
ছোট মামা
মাথার ভিতর একান্নবর্তী পরিবারের সাইকেল-চাকা
ছুটে চলছে অবিরাম- তেমনই জব্দ যান্ত্রিকতা
মেঘের প্রাচীন তর্জমা থেকে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ খসে পড়েছে
প্রান্তর নীল ঘাসের 'পর, নিংড়ে নিচ্ছে সবুজ
বিস্মিত হরিণের চোখ, মুহূর্তে মুহূর্তে মৃত্যুর স্থিরতা নিয়ে ছুটে আসছে হীরক দ্রুতি
এখন একরত্তি বৃষ্টির দামামা বাজে, অন্ধকার কেটে-ছিঁড়ে
মুষ্টি হাতে আলোয় শানাচ্ছে সোনার ছুরি, নিশুতি কালো বিড়ালের
দুধেদাঁত যেমনভাবে মাছের আঁষ ছাড়ায়
ঝরে যাচ্ছে গ্লানি।
এখন অস্থির ঘড়ির কাঁটা আর টিকটিকি আর স্তন্যপায়ী তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী
সকলেই নির্জীব অপেক্ষার পিছু পিছু কচ্ছপের দ্রুততা নিয়ে বসেছে
সূর্য পোড়া কয়লা উষ্ণ রাখছে খিদে, মাঝে মাঝে উস্কে উঠছে
ভারী হচ্ছে ক্রুর কান্না, দূরের কারখানা থেকে ফিরে এল যন্ত্র
ফিরে এলো সাইকেল বেল।
ঘুমের পাশে দেখি রাগে-গর্জনে শাসাচ্ছে আমাকে
অথচ সমস্ত দৌরাত্ম্য ফিকে মুখে জাফরান আলোর মতো এখন
সাইকেল ঘুম সাইরেন।
নারীটির জন্য এই পৃথিবী
সেই নারীর চোখেই কি অদ্ভুত এক সর্বনাশ আছে
যেন পাহাড়ের মসৃণ গা থেকে নেমে আসা উলঙ্গ ঝর্ণা
আমাকে শাসাচ্ছে, আমাকে মিশে যেতে বাধ্য করছে ধুলোর ভিতর
তারপর পিছু পিছু ছুটে আসা চাকা ঘষে যাবে আমার গর্দানে
সে ঘুরে দাঁড়াতেই বিদ্যুৎ চমক, অনিত্যের শিহরণ
আর সবকিছু চাকার নীচে থমকে গেছে
আলো-আঁধার মুছে কেবল একটিমাত্র নিশান
এর চেয়ে আর ভালো সময় নেই তাকে দেখার
পাহাড়ের সমস্ত স্বচ্ছলতা ভেসে যায়, ধুয়ে যায় নদীর গৌরব
তার মধ্য ললাটে লাল উদভ্রান্ত আভা,
আমি ভুলে যাই তার শাড়ির আঁচলে একটা বাঁকা সুতো
সে জানে না, অথবা জেনেছে
সে আমাকেই ডাকছে
আমার এমন আজীবনের কাঙালপনা সে তার হাসিতেই বারবার প্রশ্রয় দিচ্ছে
মনে হয় আমার মধ্য দিয়ে এক ফেনিল পাখি তার দিকে তির্যকভাবে ধেয়ে যাচ্ছে
আর অনবরত তার বুকের বাম স্তনের নীচ থেকে কুড়িয়ে রাখছে উষ্ণ স্পর্শ
তার এমন দেমাকি রূপ নিয়ে এসেছে পৃথিবীর খিদে
গাছেরা শূন্যে ঝাঁপ দিচ্ছে, মাটির গহ্বরে প্রকাণ্ড অগ্নিজিহ্বা
আকাশে সাঁতরাচ্ছে অগ্নি সঙ্গমে উঠে আসা নষ্ট পতঙ্গ
এ আগুন তার মধ্যেও বিছিয়ে আছে কাঁকড়াবিছের মতো
আমি দেখি, এই মহাকাল উন্মাদ হয়ে দেখে
এবং তার চোখে লাগে দুঃখের কাজল
যা এখন এড়িয়ে যাওয়া যায় না
তবুও আমি এখন ভুলে যেতে চাই ফুলের বিনীত ডাক,
তাকে একটিবার স্পর্শ করলেই ফুলেরা মৃত্যু নিতে পারে
তবে তাই হোক
আজন্মকাল ফুল ছুঁতে না পারা ও সিগারেট পোড়া আঙ্গুলের দোহাই
এই এলোকেশী সঙ্গিনীকে আমি রেখে যেতে পারবো না মহাজাগ্রত পৃথিবীর বিপদ সীমায়।
অন্ধকারের স্বীকারোক্তি
অনন্তের দুঃখ, ঝাপসা
অথচ তোমাকে পাওয়ার দুঃখ আমি কোনোদিনই পেলাম না।
ভালোবাসো!
আমি গুল্মের মতো এই সবুজ অরণ্য থেকে হরিৎ ঘ্রাণ নিয়ে যাচ্ছি
আমার শরীর থেকে পশ্চিমে উড়ে যাচ্ছে রাতের সাদা পাখি,
আর সর্বত্র লেগে আছে জোনাকির আয়ুষ্কাল
প্রলাপের মতো নিশ্চল অন্ধকার,
ব্রীড়াবনত জোৎস্না ভিক্ষুকের সাজে পাত পেতে আছে
তোমাকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে ঝর্ণার অসম্ভব সবুজ চোখ
ছড়িয়ে পড়ছে অঙ্গভঙ্গি, অসংখ্য মুদ্রা
শতদল খুলে খুলে নদীর দিকে
গতিহীন স্থিরতা
তুমি ভুলে যেতে চাইছো
অথচ রুদ্ধ সভ্যতার কাছে সুন্দররতর এই আগুন কুসুম
কোন গ্রহকোপে পুড়ছে আমাদের কাঙ্খিত সুখসত্তা
এতদূর আর কোনোরকম কথা যায় না
মাঝে অলীক পথ, সচ্ছল জলোচ্ছ্বাস, নিশ্চল বাতাবরণ
আপন সোপানে নামছে বুকের শূন্য গহ্বরে
পাথর ভেঙে ভেঙে নেমে এসো এবার
স্পর্শ করো, মৃদু চুম্বন দাও পাংশু আঙুলে
পরিত্রাণ খুঁজে পাই যেন, অবিনেশ্বর।
এই কবিতায় আমি অযুতবার লিখে দিচ্ছি ক্ষমা নামক ক্লীব শব্দটি
পরের কবিতায় পুনরুদ্ধার হবে আমার জন্মের ভ্রুণ
লুন্ঠিত অন্ধকারে।
জোৎস্না ভেজা রাত
১
সব কথাই শেষ জোৎস্নার সাথে, তবুও বিষণ্ণ দু"চোখ
শিশিরের কণা, ভোরের ফুল জাগিয়ে রেখেছে অনিমিখা।
আলোর অরণ্যের ঘা ঘেঁষে দেখি, নির্জনতার দিকে তুমি বড্ড একা এখনও....
ফিরে আসবে না বলেই, চিঠিতে লিখে যাওনি চলে যাওয়ার কোনো কথা।
তোমায় গচ্ছিত যত আলো, সদ্যোজাত ভোরের রং সবই ফিরিয়েছ,
তোমার যে ভীষণ তাড়া, তোমার ভীষণ অরণ্য প্রিয়
এক শতাব্দী মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে থাকবে না তা আগেই বলেছ....
যদি ক্লান্তি আসে, জিড়িয়ে নিতে চাও,পাহাড়ি পান্থশালায় বসে কাউকে জানিও।
আমার সকাল বয়সের সমস্ত কবিতা, রাতের কাছে বসে,
এখানে কোনো দীর্ঘশ্বাস নেই জন্মান্ধ জোনাকিদের
আমি ছুটে যাই মাতালের মতো, ঘ্রাণ নিয়ে যাই বসন্ত সমীরণে তাদের সাথে...
আর কিছুটা, আমি অচেতন হয়ে শুয়ে চুমু খাবো সাদা ফুলেদের।
২
জানলার কাছে ঝরে পড়া মুখস্থ করা দিনগুলো,
ফিসফিসিয়ে আমায় গত রাতের ঝড়ের কথা বলে।
আবার মিলিয়ে যায় সন্তর্পণে, কে যেন সন্দেহ পায়ে কুড়িয়ে আনে ধুলো
কুড়ি ছোঁয়া যুবতীরা আঙিনায় কাজল মুছে পৃথিবীর বয়েস নির্ধারণ করে অনেকখানি রাত গড়িয়ে এলে-
কতদিন কেটে যায় বিষণ্ণতায়, তোমার খোলা চুলের গন্ধে বিকেল দেখিনি অবসরে,
তোমার বয়েস বাড়েনি এখনও, স্মৃতিরা সারাদিন উড়ু উড়ু অর্থহীন মেঘ।
মাঝ পথে থমকে যাওয়া পাঁচটা বছর কেবল, যাযাবরী পালক ঝেড়ে আসনি ঘরে
তোমার সমীহ শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে আছে আমার কামিনী ফুলের মিহি নেশা।
কতকগুলো প্রহর তোমায় নিয়েই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি, রাতের উঠোনে বসে চাঁদকে বিকেলের ধারণা লিখি,
মেঘের আড়ালে যে অযুত বেদনা জমা, কি জানি বেদনার সেই রঙ হলুদ খামে বোঝাতে পারবো কি না!
হাতের ভাগ্যরেখা প্রাচীন বিষাদের মতো উত্তরাধিকার প্রাপ্ত, যেখানে জাতিস্মরী কোনো ভালোবাসা নেই।
তবুও প্রতিমুহূর্তে ভালোবাসা অন্ধ জরায়ু থেকে জন্ম নেয় বারবার, তুমি কি আসবে না!
ঢেউ
যাপিত নির্জনতা, স্বরহীন,
দিগন্তে ছুটে যায় সাঁই সাঁই শব্দরাশি, বাতাস
যেভাবে আমি অবগাহনের পথে
আমার দুপাশে নিঃসঙ্গ কয়েকজন
মুখে মুখে খড়কুটোর মতো কেবলই মিথ্যা প্রত্যাশা
ছুটে যাই আরও ছুটে যাই হাত ধরাধরি করে...
দু"চোখে ভর দিয়ে ওই অনন্ত মুগ্ধতায়, চেতনাহীন
অপার বিস্তৃত সমুদ্র সফেন
দূরে ভেসে ওঠে কবিতা, ফকির চাঁদ
বেজন্মা জোৎস্নার শিরদাঁড়া গলে যায় আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে
সেখানে তোমাকেই দেখি, প্লুতস্বরে কম্পিত সে ক্ষীণতনু
তৃষ্ণার্ত অঝোরে ঝরে পড়ে কেমন
অথচ আমাদের জন্য সুখ সাজিয়ে রাখছো জোৎস্নার তাম্রপাত্রে
এখানে অগণিত ঢেউ, হাতে-পায়ে জলের ফোঁটা
মনে হলো পৌচ্ছে গেছি
তথাপি আমাকেও ফিরতে হবে
অতএব সমুদ্র মন্থনের পর তোমার আঁচলে ঢেলে দেবো সমস্ত ঢেউ
তারপর, মা গো
আমি এবং সহোদরা
আমরা তিনজন দুঃখগুলো ভাগ করে নেবো,
তোমার ভুল ঈশ্বরের সভাঘরে
কবি পরিচিতি :
নাম : বিক্রম ঘোষ
জন্ম : ২২ শে জানুয়ারি, ১৯৯৯, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, আমতলা
শিক্ষা : ডিজাইন, শিল্প সদন, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমান)
পড়াশোনার পাশাপাশি লেখালেখি শুরু সপ্তম শ্রেণি থেকে, ২০১২। তারপর ধীরে ধীরে কবিতার প্রতি ভালোবাসা জন্মানো এবং তাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা।পছন্দের জায়গা বলতে ছবি আঁকা, বই পড়া, কবিতা পাঠ করা, খেলাধূলা, অনেক অনেক সিনেমা এবং থিয়েটার দেখা আর ঘুরে বেড়ানো।তবে এখনও পর্যন্ত আক্ষেপ গানের সাথে বসবাস করেও গান গাইতে না পারা এবং কোনো যন্ত্রের সাথে সুখ-দুঃখ ভাগ করতে না পারা। প্রকাশিত একমাত্র কবিতার বই 'ঘুম দাও নির্বাসন নয়'।
যোগাযোগের মাধ্যম: bikramghosh22199@gmail.com
Bhaiya bhalobasha niyo ❣️🌸