“But when does something's destiny finally come to fruition? Is the plant complete when it flowers? When it goes to seed? When the seeds sprout? When everything turns into compost?”
― Leonard Kohen, Wabi-Sabi: For Artists, Designers, Poets & Philosophers
জেন বলেন পথই গন্তব্য, বসার ভঙ্গিটুকু যাজেন। দুঃখ নয়, সুখ নয়, অনুভূতিশূন্যতা নয় বরং শূন্য-মনই বোধির আধার; উত্তরের পিছুটান নয়, প্রশ্নের মায়াজাল থেকে মুক্তিই পন্থা। কথার সীমানা উজিয়ে নীরবতার ভাষা শিক্ষা। সমগ্র চলচ্চিত্র জুড়ে মুখ্য দুই চরিত্র প্রায় কোনো কথাই বলেনা পরস্পরের সঙ্গে, অথচ তাদের মতো বাঙ্ময় আর কে-ই বা! কিমের চলচ্চিত্র বোনা হয় এমন এক মাত্রা থেকে যা কেবলমাত্র বেদনাতুর নয়; যার অতল থেকে জেগে ওঠে অসম্ভবের প্রতি তীব্র বাসনা, একটি অমোঘ কাঁটা যা জাগিয়ে রাখে ঘুমে, যা ছোঁওয়া যায়না, ধরা যায়না--- সেই মায়ামৃগের প্রতি বিষণ্ণ ভালোবাসা। প্রথম রিপু এবং ষষ্ঠ রিপুর যে তাড়না মানব হৃদয়কে, তার অস্তিত্ব, বর্তমান, লুপ্ত অতীত এবং অনাগত ভবিষ্যতকে টলোমলো করে তোলে ঢেউর পর ঢেউর আঘাতে; সেই অলৌকিক জলযানটি যেন তারই প্রতিভূ। কিম কি-দুক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই তাঁর অভীষ্ট দর্শককে দোদুল্যমান করে তোলেন নৈতিকতা এবং ব্যক্তিগত আস্থার প্রশ্নে। ঠিক এবং ভুলের সরল বাইনারি চলনে হাল পাওয়া যায়না তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলির ক্রাইসিসগুলির সমাধান; সেখানে অবচেতনা এবং চেতনা নির্দ্বিধায় ড্রিবল করতে করতে হৃদয়ের গোপন গলিঘুঁজি দিয়ে ঢুকে পড়ে ফাজি লজিকের রণভূমিতে; মানবমনের বিবিধ লেয়ার বা পরতে যা একে অপরের সঙ্গে সংপৃক্ত এবং প্রতিচ্ছেদিত।
আমাদের কামনাবাসনাগুলি যে কোথায়, কখন এবং কোন উৎসেচকে ফুল্লকুসুমিত হয়ে উঠতে চায়, বিকশিত হতে চায়--- তার বয়ান আমরা দেখি দুই বিপরীত-বয়সী পুরুষ এবং অসমবয়সী এক নারীর জীবন-তরঙ্গের উপরিপাতে। প্রথমেই কিম দর্শককে মুক্ত করে দেন একবিংশশতকীয় যান্ত্রিক কলরোল থেকে মহাসমুদ্রের নীল নির্জনতায়। মহাসাগরের বুকের ওঠাপড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পর্যাবৃত্ত ছন্দে একটি স্থির বিন্দুর সাপেক্ষে দুলছে আশ্চর্য নৌকা। এক দশকেরও আগে বৃদ্ধ ঘোটক কৌশলে বাজেয়াপ্ত করেছিল এক বালিকাকে। এখন সেই বালিকা কিশোরী; বৃদ্ধের জলযানে অবরুদ্ধ, ক্রমে ক্রমে সে আবিষ্কার করবে তার চেনা শরীরের ভিতর আরো এক অচেনা শরীরের, অন্যমনের, নবযৌবনের তরঙ্গগুলিকে। কোনোপ্রকার আগ্রহ-অনাগ্রহ ব্যতিরেকে কিম ধীরেসুস্থে দেখান কিশোরীর নগ্ন হাঁটু থেকে শুরু করে গোড়ালি বেয়ে পায়ের আঙুল ও পাতার দৃশ্য! সংশয়দীর্ণ, রিপুতাড়িত বৃদ্ধ কন্যাকে স্নান করিয়ে, প্রসাধনে সাজিয়ে দৈনন্দিন খোরাক জোগাড়ে ডাঙায় পাড়ি দিলে সেই আদিম বোটটিতে কিশোরী যখন একা; জর পৃথিবীর সঙ্গে তার সম্পর্কের সুতো বলতে মদ্যপায়ী, কামাতুর শখের মৎস্যশিকারিরা যারা বাজারের চিৎকার থেকে হঠাৎই এসে পড়েছে কুয়াশার কুহুকে লুকানো এই গ্রহান্তরে দিন কয়েকের জন্য, তাদের লালা এবং বদ নজরের সামনেই কিশোরী বিকশিত হতে থাকে কোয়জাই-স্ট্যাটিক গতিতে। অথচ তার এই নব প্রস্ফুটিত তণুমনের কোনো গন্তব্যস্থল, ক্রীড়াভূমি, উৎসর্গপাত্র নেই কিন্তু জলে যুগপৎ স্রোত ও জোয়ার, বয়সের জৈবিক এবং মানসিক অঙ্ক; ফলত এ তাপ প্রবাহিত হয় অলক্ষ্যে এবং সকলের সমুখেই।
তাই অস্ত্র হয়ে ওঠে সুর। যে ধনুকে ভর করে ভাড়াটে মাছুয়াদের থেকে বৃদ্ধ রক্ষা করে কিশোরীর কৌমার্য যা সে কেড়ে নেবে বলে প্রতি রাতে একটি একটি করে দিন কাটতে থাকে সময়ের হালখাতা থেকে, আবার সেই ধনুকেই শর যোজনা করে কিশোরীর হাওয়ায় ভাসমান শরীর এড়িয়ে সে বিঁধতে থাকে বোধিসত্ত্বের কপাল, গাল, কণ্ঠনালি, বুক--- দৈব সংলাপে নির্ধারিত হতে থাকে ভাগ্যলেখা। এই ধনুকই আবার হয়ে ওঠে রাতের জলজ সঙ্গীত, ভালোবাসা নাম্নী এক সান্দ্র তরল, ‘হাজারো খোয়াইশেঁ অ্যায়সি কে হর খোয়াইশ পে দম নিকলে’র মতো যার বিষণ্ণ সুর তরঙ্গাকারে প্রতিধ্বনিত হয়ে বারবার ফিরে আসে অসমবয়সী দুই মানুষের খেয়াঘরে, খেলাঘরে। কাহিনীর এই সরল দোলগতি ভেঙে দিয়ে কিম অনুপ্রবেশ ঘটান তরুণ ছাত্রটির, যে সমুদ্র-বাতাসের সঙ্গে সঙ্গেই মৎস্যকন্যার জীবনে বয়ে আনে আনকোরা, অনাস্বাদিত ভুবনের নাগরিক সুর এবং ভালোবাসা। কন্যা তখন যেন স্বপ্নোত্থিতা। তার শরীরের ঘুম ভাঙে। মনের আগল খুলে যায় নব্য আবিষ্কৃত সঙ্গীতের মূর্ছনায়, নবীন প্রেমিকের সাহচর্যে এবং উষ্ণতায়। অথচ, তার মনে দ্বিধা, সংশয়--- বৃদ্ধের এতদিনকার লালনপালনের প্রতি ধনুকের ছিলাসম টান, এই কয়েদই যেন তার চিরমুক্তি। কিম আমাদের দেখিয়ে দেন প্রতিবর্ত ক্রিয়া এবং অভ্যাসের দাসত্ব। তাঁর অন্যান্য চলচ্চিত্রের মতো নিজস্ব স্বাক্ষরে কিম স্বপ্নের ভিতর বাস্তব এবং বাস্তবের ভিতর স্বপ্ন বুনে চলেন অসামান্য মুনশিয়ানায়।
বৃদ্ধ, নবীন প্রেমিক এবং কিশোরীটির ভাগ্যলেখা অলক্ষ্যে দেখতে থাকেন শর-জর্জরিত নির্বাক বোধিসত্ত্ব। বধূবেশে সেজে ওঠে কিশোরী। ধনুকের সুরে এবং গেঁথে যাওয়া শরে কার সঙ্গে মিলিত হয় কন্যা? সে কি ঋতুমতী হলো? কিংবা প্রথম সঙ্গমের করুণ রক্তে ভিজে উঠল অমল ধবল অন্তর্বাস? বৃদ্ধের তীর তার ঘুমন্ত নববধূর বুক থেকে ক্রমে শূন্যে তাক করে; তার কামনা নির্বাপিত হয়েছে হয়তোবা, নৌকাটি যেন তার আত্মা এবং এই দেহটি তারই খোলস; বৃদ্ধ অবশেষে শান্ত; জলে গমন করে। অলৌকিক জলযান নবীন প্রেমিক যুগলকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে অনাগত জীবনের উদ্দেশ্যে। কিমের চলচ্চিত্র তার স্বকীয় এবং অনতিক্রম্য চৌম্বকীয় টানে আমাদের আছন্ন করে রাখে পরাবাস্তবাতায়, এক অনির্বচনীয় সুরে, শরে ও ধনুকের জ্যা-এ।
Kommentare