top of page

শিল্পীর হয়ে ওঠা / সুরজিৎ পোদ্দার

Updated: Oct 12, 2023

শিল্পীরা বাস্তবকে অপছন্দ করেন— নীৎশে সম্ভবত এরকম কিছু বলেছেন, বলেইছেন কিনা সেটা আমি সিওর না, কিন্তু দেওয়ালের কান দিয়ে এটাই শুনলাম। বলেছেন কিনা সেই সত্যের বিচার খুব বোরিং বিষয়, তার তুলনায় শিল্প আর বাস্তব এদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।

শিল্প এই যে এক অদ্ভুত বিষয় যেটা শুধুমাত্র মানুষ করতে পারে আর কোনো প্রাণী পারে না, সেটাই নানা কারণে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ বলেই আমার ধারণা। যা বললাম তা ব্যাখ্যা করা দরকার, নানা দিক দিয়ে এই বক্তব্যের বিরোধিতা করা সহজ। প্রথম কথা পাখিরা যে গান গায় তা কি শিল্প না? বাসা বাঁধে যেভাবে সেটা, নাচে— সেটা? ডলফিনের লাফ শিল্প নয়? সাপের নাচ (বাংলা সিনেমা ছাড়াও কি সাপ নাচে?)?— না, এগুলো কোনোটাই শিল্প বলতে যে এক সম্পূর্ণ ধারণা আমরা করি তা নয়, এখানে প্রতিটি কাজ শুধুমাত্র জৈবিক চাহিদার থেকে আসছে। জৈবিক চাহিদার সাথে শিল্পের বিরোধ নেই, কিন্তু শুধুমাত্র জৈবিক চাহিদার সন্তান শিল্প নয়। আবার শুধুমাত্র ধর্ম-নীতিকথা-দর্শন এও সে নয়। এখানেই, বস্তু ও ভাবের আরোপিত বাইনারি ভেঙে পড়ে কারণ এই দুইয়ে মিলেই শিল্প।

ছন্দের বোধ আমাদের প্রবণতায়, সুর আবেগে, চিত্র-ভাস্কর্যের পরিমাপ আমাদের যৌক্তিক বোধে; এই তিনের মিলনে ও এদের থেকে অনেক উর্ধ্বে শিল্পের কাঁচামাল; আমাদের প্রবণতাজাত ও যৌক্তিক বোধ দ্বারা পরিমিত, আবেগসমন্বিত সে; দর্শনের নিকটাত্মীয়: শিল্প। ফর্ম ও কন্টেট, ভাষা ও ভাব একে অন্যের পরিপূরক এখানে। কেউ রাজা নয়। রাজা এদের হয়ে ওঠা, তার বোধ প্রস্ফূটিত হওয়া। কারু-র থেকেও জরুরি কারুবাসনা, দুর্গাপুজো আসছে আসছে এর মধ্যেই সবকিছু, চৈতন্যদেব কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে জগন্নাথকে জড়িয়ে ধরতে চাইছেন কিন্তু ভক্তিতে উদ্বেল হয়ে মন্দিরের দরজাতেই পড়ে যাচ্ছেন— এই চাওয়া, আকুতি এটাই শিল্পের বড় জায়গা। একজন লেখক যখন লিখছেন তিনি সেই আকুতির জায়গা থেকেই লিখছেন, তিনি তখন পৃথিবীর স্বেচ্ছাচারীতম রাজার থেকেও কয়েকশোগুণ বেশি স্বেচ্ছাচারী। বিশ্বামিত্রকে দেবতারা মহর্ষি বলে মেনে নেয়নি বলে তিনি নিজের পৃথিবী বানিয়ে ফেলেছিলেন প্রায়, তারপর কোনোমতে তাঁকে নিরস্ত করে রাজর্ষি উপাধি দেওয়া হয়। ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণত্বে তিনি উত্তরণ করেন। এতো রামায়ণের কথা। একজন রাজা নিজের সমস্ত ঐশ্বর্য অস্বীকার করে কাব্য, শ্লোক, গানের আশ্রমিক অনুষ্ঠানকে নিজের সত্য হিসেবে গ্রহণ করছেন। শুক্রাচার্য প্রকৃত আদিকবি— মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের স্রষ্টা— অর্থাৎ, পৃথিবীর প্রথম কবি জীবন-মৃত্যুর অপরিবর্তনীয় নিয়মকেও অতিক্রম করে যাচ্ছেন। আর কীভাবে বাস্তবকে আক্রমণ করা সম্ভব?

অর্থাৎ, সমস্ত অস্তিত্বের বিপ্রতীপে এক অস্তিত্ব নির্মাণের সহজাত প্রবৃত্তি— অর্থাৎ, যা ঘটছে তার বিরোধিতা করা— বিপ্লব করার আকুতি, এবং এক সুচিন্তিত উপায়ে তার প্রতিফলন। তাইতো শিল্প। ভগৎ সিং খুব পড়তেন যে নৈরাজ্যবাদী দার্শনিকের লেখা, সেই বাকুনিন এই দুটো কারণেই মানুষকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জীব বলে বিবেচনা করেছেন।

এই দুই গুণ ছাড়া যুগযুগ ধরে শিল্পের মতো যা কিছু হয়ে আসছে তা প্রায়-শিল্প; শিল্প নয়। রামপ্রসাদ সেন জমিদারের খাতা লিখতে চাইতেন না তাই হিসাবের খাতায় গান লিখতেন, বাস্তবের বুক এফোর ওফোর করে চলে গেছেন, উচ্চারণ করছেন 'এই মানবজমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলতো সোনা...', শুধুমাত্র মানুষ পারে চিন্তা করতে আর তার পরিপার্শ্বকে অস্বীকার করে নতুন কিছু করতে, সেই মানুষ হয়ে সেই সুযোগ পেয়ে প্রকৃত শিল্পী ছাড়া কেউই তাকে কাজে লাগাতে পারে না!

বাস্তবকে কীভাবে অস্বীকার করছেন সেটাই শিল্পীর রাজনীতি। সেটাই তার শিল্প। তার অস্তিত্ব।

161 views0 comments

Comments


bottom of page