কথকতার রীতি ও রেওয়াজ আমাদের দেশে সুপ্রাচীন। আমাদের আটপৌরে গল্পগুলির ভিতর মিলেমিশে আছে আমজীবন, রূপকথা, রূঢ় বাস্তব, কিংবদন্তি ও প্রকৃতি। আর আমাদের আছে, শালিক রহমানের মতো বুক পকেটে এক কাঠবিড়ালি শিশু। বেঁচে থাকাটাই আত্মীয়তা। আমরা হাওয়াজাতক। দাদু-দিদিমার কাঁধে চড়ে সেই কোন শিশুকালে আমাদের হাতেখড়ি হয়েছিল বাড়ির চারিদিকের গাছগাছালি, পাখপাখালি, জীবজন্তু ও জড়ের অদ্ভুত সহাবস্থানের সঙ্গে। প্রাণের ফোয়ারা উৎসারিত হচ্ছে সবখানে। কতরকম বিচিত্র ডাক ও রব, খাদ্য প্রণালী, বাসা বানানোর বৈচিত্র, জীবন অভ্যাস। আমাদের পোষা বিড়াল, কুকুর বা পাখিদের গলায় বেড়ি পরিয়ে ধরেবেঁধে রাখতে হয়না, তারা নিজদের ইচ্ছেমতো, খেয়ালখুশি মতো আসাযাওয়া করে। ছেড়ে রেখেই ধরে রাখা। আমরা একই আকাশের নীচে খাইদাই, ঘুমাই। একই হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিই। বেঁচে থাকি। মরে যাই। এক অদৃশ্য, অমোঘ ও মুক্ত আত্ময়ীতার বন্ধন আমাদের রক্তপ্রবাহে কাজ করে। তাই, এই বৃহৎ সমবায়ে, পরিবারে বন্যরাও পোষ্য--- অবাধ, স্বাধীন এক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক।
কিন্তু, সভ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রজাতির একটি বড় অংশ হয়ে উঠেছে স্বার্থপর দেবতা। তারা তৈরি করতে চেয়েছে এমন এক স্বর্গ, যেখানে অন্যদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। প্রকৃতিকে প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছে কৃত্রিমতায়। ফলতঃ, আকাশ ছেয়েছে কালো পুরু ধোঁয়ায়। চোখ জ্বলে যায় বিষাক্ত বাতাসে। ফুসফুস, মস্তিষ্ক ও হৃদমাঝারে দূষণের সংক্রমণ। আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসছে মৃত চিলের দল। আমাদের বহুতলগুলির ছাদে ঝরে পড়ছে, 'হায় চিল, সোনালি ডানার চিল'। মহানগরের প্রান্তসীমায়, মৃত নদীর উদরে জমছে নাগরিক সভ্যতার উচ্ছিষ্ট, জঞ্জালের স্তূপ। পরিসংখ্যান বলছে, এইভাবে চলতে থাকলে অচিরেই পৃথিবীর উচ্চতম পাহাড়ের শিরোপা পাবে এই বর্জ্য-পাহাড়। সেই দিন আর বেশি দূরে নেই, যখন অম্ল বৃষ্টিতে পুড়ে যাবে ত্বক, ক্ষেত, সমগ্র চরাচর, আনখশির অস্তিত্ব। হিমবাহ গলে মহাপ্লাবনে ভেসে যাবে ভুবন। বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়বে। থাকবে কেবল এক চরমভাবাপন্ন বিশ্রী ঋতু৷ সময়ের সঙ্গে, মসনদে পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে এইভাবেই বদলে গেছে ইয়ে দিল্লী শাহনামার জল ও হাওয়া। এখন সন্দেহ, হিংসা, জাতিদাঙ্গার বাতাবরণ ও মৃত্যুর পর্দায় মুখ ঢেকেছেন দিল্লীশ্বরী। তাঁর বুকের ওপর সারিসারি কবর, পাখির ও মানুষের লুপ্ত বেরাদরির।
কিংবদন্তি বলেন--- ধূসর-কালো বিস্তৃত ডানা ও দীর্ঘ-ঈ এর মতো বাঁকানো চঞ্চুর ভুবন চিলেদের আছে এক আশ্চর্য ক্ষমতা। আমাদের শোকগুলি, দুঃখকষ্টগুলি তারা গিলে নেয়। তাই সিজদা আদায়ের শেষে নেকবান্দা এসে দাঁড়ায় খোলা চত্বরে। মাথার ওপর চক্রাকারে উড়ছে ফেরেশতার মতো চিলের দল। তাদের উদ্দেশ্যে টুকরো টুকরো মাংস ছুঁড়ে দেওয়া হয় আকাশে। গোপন ইবাদতে শোকগুলি, জাগতিক যাতনাগুলি ছোঁ মেরে নিয়ে যায় অলৌকিক চিল। আমাদের শহরকে পরিষ্কার রাখে যাবতীয় পাপতাপ এবং বর্জ্য উদরস্থ করে।
চারপাশের জীবজগতের সঙ্গে আত্মীয়তার এই সম্পর্কটি গড়ে দিয়েছিলেন নাদিম এবং সাউদের আম্মাজান। মায়ের কোলে বসে সাপ ও পতঙ্গরূপী জ্বীন ও দানো, বিল্লীবাবা, শকুন-মাজার ইত্যাদির গল্পকথার ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা শিখেছিলেন, 'যারাই নিঃশ্বাস নেয়' তাদের ভিতর বইছে একই প্রাণ, তাদের ভিতর নেই কোনো ফারাক। সেই প্রাণগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ২০০৩ সাল থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত দুই ভাই করে চলেছেন সংরক্ষণের সেই কাজ। Wildlife Rescue সংগঠনটি অদ্যাবধি চিকিৎসা করেছে, বাঁচিয়ে তুলেছে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে, মুক্ত আকাশে আবারো ডানা মেলার অবকাশ দিয়েছে প্রায় কুড়ি হাজার পাখিকে।
নৈমিষারণ্যে কুলপতি শৌনক যেমন সমাপন করেছিলেন এক মহাযজ্ঞের তেমনি শৌনক সেন এবং তাঁর সহযোগীরা নির্মাণ করেছেন আশ্চর্য এক কাব্যময় তথ্যচিত্রের। শৌনকের গল্প বলার ধরণে এক ঘরোয়া মায়া আছে। অতিকথন নেই কোনো। আটপৌরে জীবনের ভিতর যে সত্যি রূপকথা আছে, তা-ই তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে এঁকেছেন প্রতিটি ফ্রেমে। সম্পূর্ণ তথ্যচিত্রে আমরা শুনি কমবেশি উনচল্লিশ রকমের ভিন্ন ভিন্ন 'ডাক', 'রব' ও 'শব্দ'--- যা উপস্থাপিত হয়েছে প্রাণ ও তার প্রকাশের রকমফের ধারণ করতে। যে দিল্লীর ছবি শৌনক এই তথ্যচিত্রে দেখিয়েছেন, তা যেন মহাপ্রলয় পরবর্তী কোনো এক শহর, যেখানে মানুষে মানুষে অবিশ্বাস, ঘৃণা ও দাঙ্গার ভিতরেও, পচে যাওয়া একটা বাস্তু ও প্রজাতন্ত্রের পাকস্থলী থেকেও প্রাণের স্ফুরণ তথা বিকাশ ঘটছে। রাতের শহর দখল করেছে ইঁদুর ও ভনভনে মাছির দল। আবার প্লাস্টিক বর্জ্যে পরিপূর্ণ পূতিগন্ধময় ডোবা থেকে উঁকি দিচ্ছে মহাজাগতিক কূর্ম অবতার! দুরাশার মধ্যেও আলোর বাতি রোজ জ্বালাচ্ছেন কেউ।
A.J.K. Mass Communication Research Centre-এর প্রাক্তনী শৌনক তাঁর প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র Cities of Sleep-এর (২০১৬) জন্য ভূষিত হয়েছেন ছ'খানা আন্তর্জাতিক পুরষ্কারে। তিনি তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন Films Division of India fellowship (২০১৩), Sarai CSDS Digital Media fellowship (২০১৪), Charles Wallace Grant (২০১৮), IDFA Bertha Fund (২০১৯), the Sundance Documentary Grant (২০১৯), the Catapult Film Fund (২০২০)। All That Breathes (২০২২) তাঁর দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র। এই তথ্যচিত্রের জন্য তিনি লাভ করেছেন, ‘ওয়ার্ল্ড সিনেমা ডকুমেন্টারি’ প্রতিযোগিতায় সানড্যান্স চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গ্র্যান্ড জুরি’ পুরষ্কার, ৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গোল্ডেন আই’ পুরষ্কার, জুরিখ ও লন্ডন চলচ্চিত্র উৎসবে যথাক্রমে ‘শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক তথ্যচিত্র’ এবং ‘গ্রিয়েরসন’ পুরষ্কার। All That Breathes (২০২২) ৯৫তম আকাদেমি পুরষ্কারের তথ্যচিত্র বিভাগে মনোনয়ন লাভ করেছে। এই তথ্যচিত্র সম্পর্কে সানড্যান্স চলচ্চিত্র উৎসবের তথ্যচিত্র বিভাগের জুরি এমিলি বুহেস বলেছেন : “This poetic film delivers an urgent political story while constructing a singular and loving portrait of protagonists resisting seemingly inevitable ecological disaster--- with humorous touches punctuated by unsentimental depiction of the animal kingdom.” এই তথ্যচিত্র আমাদের স্বপ্ন দেখায় মানুষ ও পাখির বিশ্ব জুড়ে যৌথ খামার একদিন হয়তোবা গড়ে উঠবে।
@ সুন্দরম
Yorumlar