অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা ;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই–প্রীতি নেই–করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
জীবনানন্দ দাশের বহুবার উচ্চারিত এই কবিতাটি দিয়েই আমার 'বলার কথা' শুরু করতে যে বাধ্য হলাম, তাতে বুঝতে পারলাম—-এই কবিতাটি পৃথিবীর যেকোনো শতকের যেকোনো দশকের সংবেদনশীল মানুষই ভাবতে পারবেন, অনুভব করতে পারবেন, অর্থাৎ কিনা বলতে চাইছি মানুষ তার জন্মলগ্ন থেকেই এক 'অদ্ভুত আঁধার' বয়ে নিয়ে চলেছে। জীবনানন্দ দাশই তাঁর '১৯৪৬-৪৭' কবিতায় বলেছেন : 'সৃষ্টির মনের কথা মনে হয়—-দ্বেষ।'
জন্মলগ্ন থেকেই মানুষ আধিপত্যবাদী। সে যতই দুর্বল ও শোষিত হোক, তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বলকে পেলে সে তার উপর আধিপত্য জাহির করবেই। আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে দাঁড়িয়ে মনে হয় মানুষ তার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গেই দ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, আমরা-ওরা-র অ্যাজেন্ডাকেও অনেক পরিশীলিতভাবে, পরিমার্জিত রূপে এগিয়ে নিয়ে এসেছে যেগুলি সমারূঢ় ভাবে রয়ে গেছে তার ব্যক্তিচেতনার ভিতর, শ্রেণিচেতনার অন্তঃস্থলে, কৌমচেতনার গভীরে। যখন কোনো বিস্ফোরণ ঘটে সমাজে তখনই ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ার মতো তার আদিম, সযত্নলালিত প্রবৃত্তিগুলো যা সতত ফল্গুধারার মতো প্রবাহিত হয়, তাই তখন নগ্ন ও নির্লজ্জভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। মানুষও যেন তখন নগ্ন ও প্রচণ্ডভাবে তার অবদমিত প্রবৃত্তিগুলোর উন্মত্ত প্রকাশ ঘটিয়ে শীতল হয়। যুদ্ধ, জাতিদাঙ্গা, জেনোসাইড ম্যাক্রোলেভেলে, আর মাইক্রোলেভেলে তাই চোর সন্দেহে পিটিয়ে মৃত্যু, বাজারে দুই মহিলাকে নগ্ন করে মারধোর—-এই ধরনের পৈশাচিক উল্লাস। মানুষের গভীরে যদি এত কালো থেকে থাকে তাহলে মানুষ এতদিন সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখল কীভাবে? নানা বাহ্যিক উন্নতির মাধ্যমে সভ্যতাকে এতটা এগিয়ে নিয়ে এল কীভাবে? সর্বোপরি মানুষ এতদিনে ধ্বংস হয়ে গেল না কেন? যখন পৃথিবীর কোথাও না কোথাও প্রতি মুহূর্তে মানুষে মানুষে লড়াই, দাঙ্গা, যুদ্ধ জারি ছিল, আছে ও থাকবে। দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের খাঁড়া মাথার ওপর ঝুলছে।
এর উত্তর মনে হয় এই—-যদিও মানুষ প্রবৃত্তির দাস তবুও সে সেই সুদূর অতীতেই পেয়েছিল আরো এক উচ্চতর আনন্দের আস্বাদ। যে আনন্দ আসে জয় করার মধ্যে দিয়ে নয়, নিজেকে বিজিত হতে দিয়ে, দখল করে নয় বরং নিজেরটুকুও ত্যাগ করে, ঘৃণার মধ্য দিয়ে নয় বরং পরম প্রেমে আঁকড়ে ধরার মধ্যে দিয়েই। আর মানুষের এই প্রকল্পই যুগে যুগে আরো সুসংবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছে, মোকাবিলা করেছে তার চরম প্রবৃত্তিগুলোর বিরুদ্ধে। তুল্যমূল্যে তা নিশ্চয়ই অনেক ভারি ছিল নাহলে শরীরে অজস্র ক্ষত নিয়েও মানুষের সভ্যতা এতদিন টিকে রইল কীভাবে? কিন্তু আজ মানুষের এই মহৎ-এর দিকে যাত্রা আমাদের কাছে এতটাই স্বাভাবিক ঠেকে যে আমরা তা নিয়ে আলোচনা করি না, হৈচৈ করি না, সংবাদ চালাচালি করি না। বরং মানুষের প্রবৃত্তির পক্ষে স্বাভাবিক যে ঘৃণা, দ্বেষ, উন্মত্ততা তাই আমাদের আতঙ্কিত করে, উদ্বিগ্ন করে, উত্তেজিত করে এবং তা যে করে আর আমরা আলোচনায়, আন্দোলনে প্রবৃত্ত হই—-সেটাও আমাদের সেই সুসংবদ্ধ, মহৎ-এর দিকে যাত্রা প্রকল্পেরই অংশ যা সমস্ত কালোর বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখে আজও পৃথিবীকে, সভ্যতাকে শ্বাস নিতে সক্ষম রেখেছে।
Comments