আমরা তো কথা বলেই চলেছি, কিন্তু সেসব কথা কি সময়কে চিহ্নিত করছে, সংকটকে চিহ্নিত করছে?
কখনো কখনো হঠাৎ নিজেদের দিকে তাকিয়ে ভাবি— আমাদের যাপনের মধ্যে কি সময়ের থেকে সংকটের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার প্রবণতা নেই? বেঁচে থাকার মধ্যে কি তবে মস্ত একটা ফাঁকি এসে থাবা বসিয়ে দেয়? ফাঁকিটা কোথায় আর বেঁচে থাকার রূপ যে কেমন তা স্পষ্ট করে বোঝা তত সহজ নয় সবার কাছে। যাঁরা বোঝেন তাঁদের কেউ সেই ফাঁকিটাকে ভাববাদী নির্লিপ্তি দিয়ে ঢাকা দেন, আর কেউ কেউ নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করে সংকটকে চিহ্নিত করেন এবং তাঁর নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে দেন।
চেতনার প্রসঙ্গ তুললেই আমার সেই মেলকিয়াদেসের(গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের 'নিঃসঙ্গতার একশ বছর' উপন্যাসের একটি চরিত্র মেলকিয়াদেস) চুম্বক পিণ্ডের কথা মনে পড়ে, যার টানে গৃহস্থালির গামলা কড়াই আংটাগুলো হুড়মুড়িয়ে নেমে আসে যে-যার জায়গা থেকে, স্ক্রু পেরেকগুলো খুলে আসতে চায় আর্তনাদ করে। চেতনা তো তাই, যা আমাদের দৈনন্দিনতায় মিইয়ে যাওয়া জং-পড়া সুবিধাভোগী চিত্তকে জাগিয়ে তুলবে হঠাৎ অগ্ন্যুৎপাতের মতো! সময়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে বেঁচে থাকার পরাজয় নয়, সময়কে স্বীকার করে, সংকটের বিরুদ্ধে গলা উঁচিয়ে তোলা!
কবি যখন 'কংক্রিটের মায়ামমতা'র মতো শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন কবিতায়, পড়তে পড়তে আবিষ্কার করি আলো নিভে যাওয়া একটা দমবন্ধ সময় তাঁর লেখার চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল তখন! কিন্তু সেইসময়ও কি যা-কিছু কুশ্রীতা ও কোলাহলের ঊর্ধ্বে রাখার মতো মহৎ শিল্পকর্ম বা সাহিত্য রচিত হয়নি? অগাধ হয়েছে। অগাধ হয়েছে বলেই সেই উদাহরণ টেনে আমরা আজও আমাদের সুবিধাবাদী নির্লিপ্ততাকে আড়াল করতে পারি। বিশুদ্ধ শিল্পের দোহাই পাড়ি। আর যারা সাধারণ মানুষ, তারা মুখ বুজে সহ্য করতে করতে দৈনন্দিন চাতুরীর আশ্রয়ে দিন কাটিয়ে দিই।চেতনার থেকে দূরে থাকাকেই আমরা শ্রেয় বলে মনে করি!
কিন্তু একবার যদি ঢাকনা খুলে ক্ষতস্থানগুলো দেখতে পারতাম, আর্তচিৎকারগুলো শুনবার জন্য প্রস্তুত করতে পারতাম নিজেকে? আর পেনসিলে ধার দিতে পারতাম সময়মতো ? তাহলে হয়তো কথা না বলে, চিৎকার না করে এত শান্ত নিরুপদ্রবভাবে থাকতে পারতাম না! এমনকি মৃত্যুর পরে কবরে শুয়েও হয়তো অবিরাম কথা বলে যেতাম সময়ের বিরুদ্ধে :
"Whenever a crunching sound
is heard where I lie
it can be assumed
it’s him,
still him."
('Provision For The Journey' / Gunter Grass)
আসলে একটা শূন্যগর্ভ সময় কতদূর জাগিয়ে তুলবে আমাদের বিবেক? চারপাশের এই সংকট দেখতে দেখতে কখন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠব আমরা? পরিশীলিত মানুষ নয় হয়ে উঠব একজন অস্থির ক্ষুব্ধ মানুষ? —সময় হয়তো তারও অপেক্ষায় থাকে! আর একবার বিবেক জেগে উঠলে আমরা অভিজাত শান্ত নিচু স্বরের শিল্পের বদলে আহ্বান করতেই পারি খোলা হাওয়ার শিল্পকে!
"Against the poetry of the cafe
We set the poetry of nature
Against the poetry of the loungeroom
The poetry of the public square
The poetry of social protest."
( 'Manifesto' /Nicanor Parra )
কত কত সংকটকাল তো পেরিয়ে এসেছি আমরা। দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধের মতো নিদারুণ সংকটের তুলনায় আমাদের এই সাম্প্রতিক সময়কালকে অনেকটাই নিস্তরঙ্গ মনে হবে। সেইসব দুঃসময়ের চিহ্ন ধরা আছে কিছু অসামান্য গল্প উপন্যাসে।দগ্ধ ঘরবাড়ি আর দূর থেকে ভেসে আসা আর্তনাদ পেরিয়ে পেরিয়ে সমরজিতের পরিবারের দেশত্যাগের করুণ দৃশ্যের কথা মনে পড়লে কি শিউরে উঠি না আমরা ('খোঁয়ারি'/ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস)? স্মরণে আসে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'কাফের'-এর মতো গল্প।
তেমন নিদারুণ সময়ের ভেতর দিয়ে কি আমরা যাচ্ছি? গোধরা, ভাগলপুর, বাবরি কিংবা ঘরের সামনে নন্দীগ্রাম, বগটুই, হাঁসখালিও ততখানি সন্ত্রস্ত করে না, যে ক্ষমতা ও বিস্তার থাকে একটা যুদ্ধে, একটা দেশদখলের ঘটনায়, একটা স্বাধীনতার লড়াইয়ে, দেশভাগের সমস্যায়! তা সত্ত্বেও কেন আমরা আজ কথা বলতে ভয় পাই? ছোটো ছোটো অন্যায়গুলোকে চিহ্নিত করতে ভয় পাই? লেখার সময় পাশ কাটিয়ে যাই চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষতগুলিকে? কেন? নিরুপদ্রব জীবন কাটানোর লোভে, ছোটো ছোটো সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে আমরা 'বলার কথা' বলতে পারি না!
আমাদের সময়েও তো শিবনারায়ণ রায়, যতীন সরকার, বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীরা রাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে কথা বলেছেন, সমাজের যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন।বদরুদ্দীন উমর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পুরস্কার কীভাবে লেখককে নষ্ট করে।তাই কোনো পুরস্কারই গ্রহণ করা উচিত নয়।তাঁর এই কথার সূত্র ধরেই বলা যায়, পুরস্কারের লোভ কি আমাদের সত্যি বলার ক্ষমতাকে ধ্বংস করে না? একেবারে নির্জীব নির্বিরোধী করে তোলে না? সাম্প্রতিক কালে আমার মনে হয়, এটাও একটা সংকট ; যে-সংকটের কথা প্রায় একশো বছর আগে রম্যাঁ রলাঁ বলে গেছেন।"বুদ্ধিজীবীগণ সুবিধাভোগী শ্রেণি। শোষণকারীরা যে সম্মান ও সুযোগসুবিধা তাদের দেয়, তাতেই কৃতার্থ হয়ে তারা জনসাধারণের আদর্শের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে।"('শিল্পীর নবজন্ম'/ রম্যাঁ রলাঁ/ অনুবাদ : সরোজ দত্ত) এই কথা যে কতখানি সত্য, তা সম্প্রতি টের পেয়েছি আমরা। এ রাজ্যের সাম্প্রতিক কিছু মর্মন্তুদ ঘটনায় চুপ করে থাকতে দেখেছি প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের। এর প্রধান কারণ, তাঁরা সুবিধাভোগের নিশ্চয়তা থেকে বেরোতে চাননি।
একটা দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আমরা যদি সেই সময়ের ক্ষতটাকে স্বীকারই না করতে পারি, যদি অন্ধের মতো বিশুদ্ধ শিল্পের দোহাই পেড়ে যন্ত্রণা আর কান্নাগুলোকে এড়িয়ে যাই, তবে সেই সময় কি আমাদের ক্ষমা করবে?
কেন বিপজ্জনক সময়ের সাহিত্য বিপজ্জনক হবে না? কেন আমাদের বক্তব্য রাষ্ট্রের কাছে বিপজ্জনক না হয়ে, হয়ে উঠবে আরামপ্রদ চাটুকারিতা মাত্র? তবে কি সুবিধাভোগ করতে করতে সহজ খ্যাতির আকাঙ্ক্ষায় ক্রমেই নিজেদের পঙ্গু করে তুলছি আমরা ? আজকের সংকটকে স্বীকার করে আমাদের আজ উচিত যেকোনো বশ্যতা থেকে বেরিয়ে আসা; আমাদের কথা, আমাদের সাহিত্য, শিল্প হোক আরো শাণিত তীক্ষ্ণ!
Too much blood has run under the bridge... আর নয়, ইতিহাস সাক্ষী আরো অনেক গভীর ব্যাপ্ত সংকট ও অন্ধকার অতিক্রম করে এসেছি আমরা। কত কত শিল্পী সাহিত্যিককে হত্যা করা হয়েছে, দেশান্তরী হতে হয়েছে কত বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদীকে, তবু অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা থেমে থাকেনি।তবে কেন আজ চুপ করে থাকাকেই শ্রেয় মনে করছি আমরা? নিজের অজান্তেই কি আমাদের স্বরকে বিকিয়ে দিয়েছি কিংবা বন্ধক রাখছি? কেন আমরা আনিস খানের হত্যা নিয়ে গলা তুলতে পারব না?
শাসকের অঙ্গুলিহেলনে ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা চলছে, আংশিক সত্যকে জনমানসে তুলে ধরা হচ্ছে তবু আমরা নীরবতা পালন করে চলেছি। এই কি তবে দুর্দিন নয়?
দেশের মধ্যে ঘটে চলা যেকোনো অন্যায় বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে কথা বলেই তো আমরা দেশকে ভালোবাসার একটা অর্থ খুঁজে পেতে পারি কিংবা শাসকের প্রতি ঘৃণা ছুঁড়ে দিয়ে! যেভাবে দেশ থেকে নির্বাসিত হয়েও দেশকে গভীরভাবে ভালোবাসতে পেরেছিলেন আমাদেরই সময়ের কবি আদনান আল-শায়েখ! ইরাকের চূড়ান্ত নৈরাজ্যকে নিয়েই যিনি কবিতা লিখেছেন আর সে-কারণেই ইরাকের শাসক তাঁকে দিয়েছে প্রাণদণ্ড।
এক দেশ থেকে আরেক দেশে আত্মগোপন করে থাকতে থাকতে তিনি লিখে ফেলেছেন 'নির্বাসনের পথ'(Passage To Exile)-এর মতো কবিতা। তাঁরই অন্য একটি কবিতা পড়তে পড়তে এই লেখা শেষ করব।
"প্রতিবার যখন কোনো স্বৈরাচারী শাসকের পতন ঘটে
ইতিহাসের সিংহাসন থেকে, অশ্রুতে ভিজে যায় পথ
আমি জোরে জোরে করতালি দিতে থাকি
যতক্ষণ না হাত দুটো লাল হয়ে যায়।
কিন্তু বাড়ি ফিরে
টিভি চালালেই দেখি
আরেকজন একনায়কের নাম
ভেসে উঠছে মানুষের মুখে মুখে, চারপাশে হর্ষধ্বনি
আমি হেসে মরে যাই
কান্নায় পুড়তে থাকে আমার চোখ দুটি
যতক্ষণ না তারা লাল হয়ে ওঠে।"
('অকপট' / আদনান আল-শায়েখ/ অনুবাদ : শ্রী পর্যটক)
কবিতাটি পড়ি আর পৃথিবীর এইসময়ের শাসকদের মুখগুলো একে একে ভেসে ওঠে।তারপরই মনে হয়, আমরা কীভাবে অন্যায়ের পীড়নের সামনে ক্লীবের মতো বেঁচে থাকায় অভ্যস্ত উঠছি দিন দিন! আর যখন নিরুপায় হয়ে গলা তুলতে চাইছি, মর্চে পড়া স্বরের মতো গলা জড়িয়ে যাচ্ছে, অস্পষ্ট দুর্বল হয়ে উঠছে যা বলতে চাই।আজ সময়ই আমাদের ডাক দিচ্ছে — 'বলার কথা' গলা উঁচিয়ে বলতে না পারলে ভবিষ্যৎ আমাদেরই দিকে আঙুল তুলবে। বিশৃঙ্খলা অন্যায় অপশাসনের বিপরীতে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারিনি বলে।
留言