শিল্পের সঙ্গে ‘গণ’ শব্দটির বৈরিতা অতঃপর আমরা সর্বান্তকরণে মেনে নিলাম; আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করলাম যাকিছু ‘গণ’ তার থেকে শিল্প বহুদূরে অবস্থান করছে। বিশুদ্ধতম শিল্পের দিকে আমাদের এই অভিযাত্রা সফল হোক। আমাদের যাত্রা পথে যেন কোনও দিন কোনও নুড়িপাথরের বাস্তবতা ছায়া না-ফেলে।
ওঁ, শিল্প… মহাশিল্পের জয়।
এবার আমাদের শিল্পের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা কয়েকটি দৃশ্যের দিকে একবার, দু’-বার চোখ মেলে তাকিয়ে নেওয়া যাক।
দৃশ্য এক- ইউক্রেনের হাসপাতালে আছড়ে পড়ছে মিশাইল। বুম হাতে দূর থেকে সে দৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে চলেছেন সাংবাদিক। তাঁর পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে একটি ভয়ার্ত কুকুর।
আমাদের রণ-রক্ত-সফলতা থেকে তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, ইউক্রেনের কুকুর।
দৃশ্য দুই- গণ-কবর আবিষ্কৃত হচ্ছে, কবরের ভেতর বুম হাতে, ফিসফিস করতে করতে নেমে যাচ্ছেন সাংবাদিক। দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি আগুন-নেভানো গাড়ির মতো ভাঙাচোরা গাড়ি। ধোঁয়া। কিছুক্ষণ আগে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাতে। আবার ইউক্রেন।
এরপর একটি ‘কল্পনা’; আসলে কল্পনা ছাড়া দৃশ্যের প্রকৃত মুক্তি নেই কোথাও। দৃশ্য মূলত কল্পনার শরীর’কে আশ্রয় করে শেষপর্যন্ত পরিত্রাণ পায়। এমন এক জটিল ও দুর্বোধ্য ‘হাইপোথিসিস’ থেকে মুক্তি পেতে গাড়িটিকে কল্পনা’ই করে নেওয়া যাক ওয়াটার-স্প্রিংকলার হিসাবে।
কবরের পর কবর খুঁড়ে যেতে হবে, বিরাম নেই। ফলে মাটি নরম করতে জল-বহন করে এনেছিল গাড়িটি।
আমাদের মহাশিল্পের তরফ থেকে ‘গণকবর’ তোমাকে প্রণাম।
দৃশ্য তিন- মণিপুর ও দান্তেওয়াড়ায় একের পর এক জঙ্গির নিকেশ ঘটছে; অথচ দেশের কত শতাংশের হাতে যেন কত শতাংশ সম্পদ! ডিজিটাল সংবাদপত্রের ডিজিটাল পেজে চোখ বোলাতে বোলাতে বেরিয়ে পড়ছে মানুষ; ঘরে ফিরে আসছে অদ্ভুত এক ফিয়ার-সাইকোসিসে আক্রান্ত হয়ে। হ্যাঁ, ডিজিটাল মানুষ।উফ, দেশে, বিশ্বেএতডিজিটাল-স্বর্ণযুগআগেআসেনি। ইতিহাসেকোনওদিনআসেনি। ট্রেনের কামরায় আলোচনা; আলোচনার একমাত্র বিষয় নিতা আম্বানির প্রতিদিনের চা-খরচ আর বিশেষ ধরনের জলের দাম। মোবাইলে ক্লিপিংস, একমাত্র রাজনৈতিক ভাষ্য- ‘ইয়ে ডর মুঝে আচ্ছা লাগা...’।
পোস্ট-কোভিড যুগে মাইনে হু হু করে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এবং ‘শোষণ’ শব্দটিকে আজকাল আনঅর্গানাইজড সেক্টরের সবাই প্রায় সন্দেহ করতে শুরু করেছে। মালিকের নৈতিক অধিকার রয়েছে শোষণ করার। কারণ, দিনের পর দিন ছড়িয়ে দেওয়া অদ্ভুত এক ডিসকোর্স তাদের মধ্যে প্রবেশ করেছে। প্রবেশ করেছে তাদের চামড়ার তলায়, শিরার মধ্যে।
আট-ঘণ্টা শ্রমের ইতিহাস গুপ্তযুগে লুপ্ত হয়ে যাওয়া কাল্পনিক সত্য ঘটনার মতো বেঁচে রয়েছে তাদের কাছে।
এবং কেউ কেউ তির ছুড়তে গিয়ে অসহায় বোধ করছে; কারণ মালিক ‘অদৃশ্য’ হয়েছে।
কিন্তু মানুষ মূলত ‘মেরু-প্রদেশে’ বাস করা অদ্ভুত এক জীব। (‘জীব’ শব্দটি লেখার আগে দু’-বার ‘পোকামাকড়’ লিখতে চেয়েছি; থমকেছি। কারণ, সোনার মাছি বাস্তবিক হয়ে গেছে শক্তিচট্টোপাধ্যায়ের হাতে। অতএব ‘পোকামাকড়’ অদ্ভুত সুন্দর হতে পারে। যদিও সে ‘জীব’, কিন্তু শুধুমাত্র ‘জীব’ শব্দটির ভেতর একধরনের নিরক্ত মাংস রয়েছে। অতএব মানুষ ‘জীব’, এ ধারণায় থিতু হলাম)। পোস্ট কলোনিয়াল রিটার্ন অফ রেলেজিয়ন এ পৃথিবীকে আবা রবাই-পোলার করে তুলবে, তুলছে।
আমাদের মহাশিল্পের তরফ থেকে, হে, পোস্ট কলোনিয়াল রিটার্ন অফ রেলেজিয়ন, তোমাকে প্রণাম।
এখানে কানে কানে কে যেন এসে বলতে শুরু করেছে, হে, গণ্ডমূর্খ, রবীন্দ্রনাথ’কে দেখ, জীবনানন্দ’কে দেখ। শিল্পের কোনও দায় নেই ‘গণ’কে জাস্টিফাই করবার। বিশুদ্ধ শিল্পের মধ্যে রয়েছে গণ’কে অতিক্রম করে যাবার অমোঘ ক্ষমতা। ফলে যে শিল্প গণ’র তার মৃত্যু সুনিশ্চিত।
এত ‘বিশুদ্ধতা’ নিয়ে এখন আমি কী করব, টোডরমল?
আলোকের এই ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দিতে দিতে কেউ আমার গা থেকে চামড়া খুলে নিয়েছ, সর্বাঙ্গ জুড়ে দগদগে ক্ষত।
এই যে গণ-শয়তানের হয়ে ওকালতি করা, একে কি মেনে নেবে শিল্প-সাহিত্য?
আহ জীবনদেবতা আমার, আহ আটবছর আগের একদিন- আমাকে কি মেনে নেবে বাংলা সাহিত্য?
এমন কি মৃত্যু-পথযাত্রীর’ও প্রাণভিক্ষা করবার অধিকার আছে; অধিকার আছে স্বপক্ষে সওয়াল করবার।
অতএব কিছুটা অক্ষম কথা বলে নেওয়া যাক।
মহাত্মা গান্ধী’কে নিয়ে জীবনানন্দের দীর্ঘ, দীর্ঘ কবিতাটি পড়েছেন নিশ্চয়; অথবা ‘১৯৪৬-৪৭’। উদাহরণ দিয়ে তালিকা দীর্ঘ করবার কোনও অর্থ’ই হয়না। এই দীর্ঘ দীর্ঘ দিন কবিতার সঙ্গে ওঠাবসা করে প্রতীতি জন্মেছে কোনও মহৎ শিল্পীই মৌলবাদী নন। যে কোনও ধরনের মৌলবাদ শিল্পের শত্রু। মৌলবাদীরা আর যাই হোক, শিল্পী হতে পারে না। যেমন ভ্যান গগ মৌলবাদী ছিলেন না; ফলে তিনি ‘দ্য স্টারি নাইট’-এর পাশাপাশি ‘দ্য পটেটো ইটার্স’ সৃষ্টি করেন। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘দ্য স্টারি নাইট’-এর সমান উচ্চতার শিল্প কি ‘দ্য পটেটো ইটার্স’?
তর্কের খাতিরে যদি ধরে ওনে ওয়া যায় যে প্রথমটি এই গ্যালাক্সির অন্যতম সেরা সৃষ্টি এবং সেটির ক্ষেত্রে যদি ‘সুপারলেটিভ’ বিশেষণ ব্যবহার করাও যায় তবু আমি বলতে বাধ্য তিনি যদি পূর্ব ধার্য কোনও ‘শর্ত’কে মান্যতা দিয়ে ‘দ্য পটেটো ইটার্স’ সৃষ্টি না-করতেন, অর্থাৎ সেটি সৃষ্টি হবার সমস্ত সম্ভাবনা থাকা পরেও তিনি যদি বিশুদ্ধতা অথবা ‘গণ’-উপাদানের সামান্যতম ইশারা থাকার কারণে বিষয়টিকে বাতিল করতেন তা হলে তিনি শিল্পের শর্ত লঙ্ঘন করতেন। তিনি সে মুহূর্ত থেকে রূপান্তরিত হতেন মৌলবাদী সত্তার অধিকারী এক মানুষ হিসাবে। কিছুটা প্যারাডক্সিক্যাল; তা হননি বলেই তিনি ভ্যান গগ হয়েছেন। এখানে ছবিটির অঙ্কন’ও গৌণ; এর পরিবর্তে অন্য চিত্রও সৃষ্টি হতে পারত। প্রবণতাটিই মুখ্য।
আর হে, জীবনদেবতা (অথবা ‘দেবী’)... ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি / বিচিত্র ছলনাজালে / হে ছলনাময়ী!’ ওই বিস্ময়চিহ্নটির সামনে বহুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। কী প্রচণ্ড বিস্ময়... জীবন-মৃত্যুর দুয়ারটুকু পার হতে গিয়েও বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন। তার আগেই ঘটে গেছে প্রথম দিনের সূর্য’কে প্রশ্ন করা ইত্যাদি। শেষের দিনেও যে উত্তর পাওয়া যাবে না তার প্রকাশ্য ঘোষণাই তো করে দিয়েছিলেন। ফলে জীবনদেবতার ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠেছে।
কিন্তু তিনি ‘বিধি’ ইত্যাদি শব্দ লিখছেন এবং লিখছেন, ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান- / তুমি কি এমনি শক্তিমান!’ আবার একটি বিস্ময়চিহ্ন। নিয়তি ও বিধি নিয়ন্ত্রিত বাঁধনে বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে কৈশোরেই। সে সময়েই মোড়ের মাথায় ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে’ আর কালো, হনু জেগে ওঠা নারীদের কণ্ঠে ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ এবং ‘ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না’ শোনার পর আর কারও মনে বিধি এবং নিয়তির ছায়ামাত্র থাকতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
কিন্তু শিল্প এখানেও সমস্ত ছায়াকে অতিক্রম করে যায়, যেতে পারে। প্লাবনের পর পলি নিয়ে আলোচনা চলতে পারে, প্লাবনকালে সে আলোচনার কোনও অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
সৃষ্টিকে গ্রহণ করবার প্রাথমিক ধাপটি ওই প্লাবনকাল। ‘বিধি’কে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ছুটে যাচ্ছে, ‘শাসনে যতই ঘেরো আছে বল দুর্বলেরও’। দানবের শক্তি যার পেট চিরে দিয়ে গেছে তার কাছে আর কী অস্ত্র থাকতে পারে অভিশাপ দেওয়া ছাড়া? বিশুদ্ধতম অভিশাপ বিশুদ্ধ মন্ত্রের মতো। ফলে ‘আমাদের শক্তি মেরে তোরাও বাঁচবি নে রে’। হে, মহাশিল্পের শিল্পাচার্যগণ, একবার লক্ষ করা যাক ‘শক্তি’র পর ‘মেরে’ শব্দটির দিকে। ‘বোঝা তোর ভারি হলেই ডুববে তরীখান’... কোন সে শীর্যবিন্দুতে গিয়ে রক্তচোষা ড্রাকুলার পেট ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়বে, নিশ্চিত হবে তার মৃত্যু, সে দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নেই। এখানে ‘অসহায়’ শব্দটি ব্যবহৃত হল বটে, আসলে সমস্ত অসহয়তার পরেও জেগে থাকে মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছা। এ বেঁচে থাকার ইচ্ছার প্রকাশ যে ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ হতে হবে, আপনার-আমার শ্রেণী সচেতনতার ধারা মেনে নির্মিত হতে হবে তার কোনও মানে নেই। বায়েজের ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ ‘গণ-উপাদানে’ পূর্ণ আর বেলাফন্টের ‘মেরি’জ বয় চায়েল্ড’-এ গণ-উপাদান নেই- এ ধারণাও মৌলবাদের উলটো পিঠ। জেসাসের আগমনে উদ্বেল হয়ে ওঠা মেষপালকের দল- এর থেকে বেশি ‘গণ’ আর কোথায় আছে!
ফলে, মহাশিল্পাচার্যগণ, রবীন্দ্রনাথের এ গানে ওই ‘ভগবান’ই গণ-উপাদান আনয়ন করেছে- মেনে নেওয়া জরুরি। কারণ, শিল্প শেষতক কোনও মৌলবাদকেই সমর্থন করে না।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের বিষয়টির পরেও কি বাংলার শিল্প-সাহিত্য কি আমায় মেনে নেবে? ‘গণ’র দিকে চেয়ে শিল্প সৃষ্টি ‘নিশ্চয়’ ‘অশ্লীলতা’; কিন্তু সচেতনভাবে ‘গণ’-উপাদানকে একপাশে সরিয়ে রাখা অশ্লীলতার চূড়ান্ত।
গত কুড়ি বছরে স্ট্রিট-কর্নার থেকে গণ-সংগীত কর্পূরের মতো উবে যেতে শুরু করেছে। ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে সেই যে গঙ্গার ‘অবিরাম’ বয়ে যাওয়া তা রীতিমতো ভাবিয়ে তোলার মতো বিষয় বটে। ভাবিয়ে তোলার মতো বিষয় এই ‘গণ-সংগীত’-এর কয়েনেজটিও। আসলে ট্র্যাক থেকে সরে এসে তেমন ‘সংগীত’ই সৃষ্টি হচ্ছে না যা গণ’র কাছে বিশেষ আবেদন নিয়ে ধরা দেবে।
বিশুদ্ধতম ট্র্যাকে ছুটে চলেছে মালগাড়ি, শিল্পের সমস্ত ‘ডাল’ (‘শাখা’ শব্দটির মধ্যে বিরল প্রভা রয়েছে, তা এখন ব্যবহার না-করাই সঙ্গত)।
ফলে ইউক্রেনের কুকুর, গণ-কবরের দিকে ছুটে আসা ওয়াটার-স্প্রিংকলার, দান্তেওয়াড়া-মণিপুর, পোস্ট-কোভিড যুগ- আমরা পণ করেছি তোমাদের দিকে তেমন ফিরে তাকাবো না।
এই শান্তিকল্যাণ থেকে তোমরা আপাতত, হে মহাশিল্প, প্রণাম গ্রহণ করো। আর হ্যাঁ, এই ‘গণ’র সঙ্গে কিন্তু জনপ্রিয়তার সরলরৈখিক কোনও সম্পর্ক নেই। এ ‘গণ’ অনেক উচ্চমার্গের এক বিষয়।
যেদিন থেকে প্রামাণিক সূত্রে জেনেছে এক সত্যদ্রষ্টা, ঋষিতুল্য কবির কথা, যিনি জনপ্রিয়তাকে মাপকাঠি গণ্য করে কয়েকজন কবির নাম বিস্তর জায়গায় সরলমতি ব্যক্তির মতো সাজেস্ট করতেন সেদিন থেকে তাঁর প্রতি আমার সন্দেহ জন্মেছে। আমি চাই না আপনাদেরও এক পরিণতি হোক।
ফলে প্রথমেই জনপ্রিয়তা আর ‘গণ’-উপাদানকে পৃথক করুন।
পার্থজিৎ চন্দের লেখা বরাবরই শিল্পের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে কী আশ্চর্য গদ্য বুননের মধ্যে দিয়ে অনায়াসেই নতুন ভাবনার জগতে পৌঁছে দিতে পারে পাঠককে। অসাধারণ ❤️🙏
অনেকখানি ভাবিয়ে তুলল! বিটলসের একটা গান খুব খুব মনে করিয়ে দিল লেখাটা! 'Come together, right now, over me..'
গুরুত্বপূর্ণ লেখা। ভাবার বিষয়।