top of page

মণিপুরী কবিতা অনুসৃজন- ঔষ্ণীক ঘোষ সোম

Updated: Oct 12, 2023



রঘু লেইশাংথেম



ক্রুদ্ধ অরণ্য


কবিতা লিখছি,

আর আজ

কী আনন্দের সঙ্গে তারা খেলছে-

আমার ক্ষুধার্ত সব ছেলেমেয়ে

তারা কি আমার কবিতার শব্দে

মিলে মিশে একাকার?


সেই কাব্যিক গ্রামে,

এখন,

আমার ক্ষুধার্ত উলঙ্গ ছেলেমেয়ে

মাতৃদুগ্ধের সন্ধান করে ফেরে,

এই পোড়া দেশে

এক ফোঁটা জলও নেই

যা আমার কবিতাকে ধুয়ে দেবে।


আজ আমার ক্রুদ্ধ তৃষ্ণার্ত শব্দেরা

স্তব্ধ হয়ে আছে,

বুদ্ধের প্রস্তর মূর্তির সামনে,

তীর ধনুক হাতে

কবিতার অরণ্যে শিকার করবে বলে।







গান্ধীর প্রস্তর মূর্তি


গান্ধীর প্রস্তর মূর্তি

কোনো কথা বলে না।


চুপ,

চুপ,

চুপ করে থাকো।

গান্ধীর অহিংসা যে

রক্তে বোনা আছে।


অন্ধকারে এক মাটির প্রদীপ জ্বলে,

হায় রাম রাম রাম,

সেই অহিংসা

এখন বন্দী

হিংসার কারাগারে।


এদিকে

শান্তির পারাবত

মাটিতে লুটিয়ে আছে

রক্তাক্ত

শর বিদ্ধ।


তাই,

এখন গান্ধীর প্রস্তর মূর্তি

নিশ্চুপ থেকে যায়।






আমারই দোষ


পাহাড়ের কিনারা থেকে

প্রতিধ্বনি ভেসে আসে।


আমি স্তব্ধ হয়ে থাকি


প্রশ্নেরা এসে দাঁড়ায় মুখোমুখি

প্রশ্ন করে বারবার

আমার স্বপ্নের প্রশ্ন।


এখন


এক ভয়ংকর স্বপ্ন ফিরে ফিরে আসে

গাছেদের গুঁড়িতে

নিঃশব্দ বুলেটের ক্ষত দাগ

আমি আমার শেষ উত্তর দিয়ে ফেলেছি।






হ্যালো দিল্লী


এই পাহাড় চূড়ায়

তোমার সন্তানেরা দোলনায় খেলা করে

ময়লা বৃষ্টি ফোঁটায় সিক্ত,

মায়ের শরীরে একটাও সুতো নেই।


আলোর অনুপস্থিতিতে

খাদের গহ্বরে শিশুরা খেলা করে।

কন্ঠ রোধ হয়ে আসা গ্রামে

জলপাই রঙ ধর্ষণ করে অজস্র নারীর দেহ

তাদের সতীত্বের আবরণ টেনে খুলে নেয়।


হ্যালো! দিল্লী,

এটা পাহাড়ি মানুষের কুড়েঘর,

যা ঝড়ের ভিতর দিয়ে

বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে

যুগযুগ ধরে নিজের দেশেই অপরিচিত।


গ্রামবাসীদের কাছে

এই পাহাড় চূড়াই পৃথিবী,

এই কুঁড়েঘর তাদের আশ্রয়।


হ্যালো! দিল্লী,

আমরা এখনো বেঁচে আছি,

বন্দুকের গর্জনে

অভ্যস্ত।





রঘু লেইশাংথেম – জন্ম ১৯৫৯ সালে। ১৯৭০-এর দশক থেকে লেখালেখি শুরু। কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন ছোটদের জন্য গল্প। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার সহ একাধিক সম্মানে ভূষিত।











থাঙজম ইবোপিশক



বাচ্চা বিক্রির বাজার


একটা বাচ্চা বেচতে চাই

একটা বাচ্চা বেচতে চাই

একটা বাচ্চা বেচতে চাই


মৃত না জীবিত?

বাসি না টাটকা?


সে এখনো জীবিত

এখনো খুবই টাটকা

শুধু একটাই বুলেট লেগেছে শরীরে;

বন্ধু, এর থেকে আর বেশি তাজা

কিছুই পাবে না জেনে রেখো।






চাঁদের মুখ


যখন দেখলাম ইয়েনজেন¹ মাসের পূর্ণিমার চাঁদ

মনে হল-

এ যেন ঘৃতহীন ‘ঝলসানো রুটি’

যেন বাংলার কবি সুকান্তের প্রতিধ্বনি।

সেই সব দিন আমরা তেমন রাঁধতাম না ঘরে,

ভাতের বদলে খেতাম তেলহীন রুটি,

ক্ষুধা চেপে রেখে রাতের পর রাত।

সেটা ছিল ১৯৬৫-এর গ্রীষ্মকাল,

যখন চাল ছিল আকাশচুম্বি।

তখন আমার সদ্য যৌবন

প্রেম সরোবরে নিমজ্জিত,

চোদ্দ দিনের যুবতীর চাঁদ

প্রেয়সীর মুখ মনে করাত।

সেই অপরূপা চন্দ্রালোকিত মুখে

কেন কলঙ্কের এত আনাগোনা?

এখন বৃদ্ধ আমি

প্রেমের রাজ্য থেকে অনেক দূরে।

যখন চাঁদের মুখটা দেখি,

রাজনীতিকের প্রস্তর মুখ মনে পড়ে-

ক্ষতবিক্ষত চ্যাটচ্যাটে অমসৃণ।

বিরামহীন লাফ দেয় ব্যাঙের মতো

একদল থেকে আরেক দলে

মিশে যায় তার দৃঢ় প্রতিচ্ছবি।




1. মণিপুরী ক্যালেন্ডার এর চতুর্থ মাস। ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী জুন-জুলাই।




আগ্নেয়গিরি তুমি ঘুমিয়ে থাকো


তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে :

আগ্নেয়গিরি, ঘুমিয়ে থাকো

তুমি জাগতে পারো না

ঘুমন্ত হয়েই থাকো

তুমি ক্রুদ্ধ হতে পারো না।

অঙ্গার থাক তন্দ্রাচ্ছন্ন

তাতে আলোড়ন তুলোনা

থাক তা মৃতের মতো

তুমি হঠাৎ এভাবে জেগে উঠোনা।


অন্ধ অবরুদ্ধ খাঁচার ভিতর,

তারা সহ্য করবে কি করে?

বদ্ধ চোখ শৃংখলব্ধ যারা,

স্বেচ্ছায় উড়ে যেতে চায় আকাশে

আদিম বাতাসের সাথে

তারা কি সদ্যোজাত পক্ষী শাবক

যাদের সদ্য পালক ফুটেছে,

তারা কি অমৃতের সন্তান?


ঢেকে দাও আবর্জনা, ঢেকে দাও বিষ্ঠা,

ঢাকো ঊরুদেশের কুকীর্তি সব;

গড়ো অনুতাপহীন নষ্ট সমাজ

আগামী অজস্র প্রজন্মকে নিয়ে :

তারপর বলো,

আগ্নেয়গিরি, তুমি শান্ত থাকো

ঘটিও না বিস্ফোরণ,

অঙ্গার, চোখ খুলো না।


এইতো গতকাল এক শিশু

মা-বাপের চোখের মণি,

তাবিজ জড়ানো কাপড়ের গিঁটে,

স্কুল ব্যাগ নয় বন্দুক হাতে ধরা ছিল তার

মায়ের চোখের জল ফেলে রেখে

কোথায় গিয়েছে ওরা?


ধুলোয় পড়ে আছে বিষ্ঠা,

অধার্মিক অপকর্ম সব ঊরুর উপর ঊরু

তারপর দেখো,

দেখো নিজেদের প্রাচুর্যের দিকে :

দূরের ওই জনবসতহীন পাহাড়ের দিকে,

যারা খাঁচা ছেড়ে উড়ে গেল

সেই সব নিষ্পাপ অমৃতের সন্তানেরা,

সেই সব পাখিরা শিকারির গুলিবিদ্ধ।

তাদের শরীর থেকে ঝরছে রক্ত

তাদের চাকাগুলো বিকৃত,

বিধ্বস্ত সুরে কেঁদে চলে

পাহাড়ের লাল ধুলোয় বেদনাতুর

আর্তনাদ করে।

কীভাবে হল তাদের শেষ পরিনতি?


তারা ছেড়ে গেছে এক স্বপ্নের দীর্ঘশ্বাস

এই নীল অন্তহীন আকাশের তরে,

অসমাপ্ত।







তোমার জন্য মরতে রাজি নই, মণিপুর


মণিপুর,

লোকে তোমায় মা বলে ডাকে,

আমিও তাই ডাকবো,

কিন্তু তোমার জন্য আমি মরতে রাজি নই।


যখন আমি দেখি

নোংরামি আর হাত সাফাইয়ের খেলা

এই বিশ্বাসঘাতক রাজনীতি,

বড় বিরক্ত লাগে।


কাউকে ঠেলে দাও ভিখারি হতে

আর কেউবা রাজার ভাগ্যধারী।

তারা কি সবাই তোমার সন্তান নয়?

তারা কি বহিরাগত?

মণিপুর, আমি তোমার জন্য মরতে রাজি নই।


মানুষে মানুষের

আলো-আঁধারের গহ্বর খুঁড়ে দেয়

স্বর্গ-নরকের অসমতা বারবার ফিরে আসে

কার এই কারসাজি?

কারই বা আইন?

ঈশ্বরের রাজ্য?

হাঃ! হতেই পারে না!

একে কি বলবে কর্মের ফল?


যদি বলো তোমার সন্তানেরা

যারা থেঁতলে দেওয়া দারিদ্রের ভারে

চোখের পাতাও খুলতে পারেনা

তারা তাদের পাপের তরে পাপ চিবোচ্ছে।

যদি দাবি করো যে এ ঈশ্বরের বিচার,

কর্মফল, সেই ঈশ্বরই তোমার উপর

ভীষণ চটে যাবেন, মণিপুর!


সেসব লোকেরা অন্যের উপরে পা দিয়ে চলে,

তারা অপরের নাড়ি-ভুঁড়ি খেয়ে বেঁচে থাকে,

হে মানুষ,

কেন তুমি মিথ্যে ঈশ্বরকে দোষ দাও?


যারা তাকে ঈশ্বর বলে ডাকে,

যারা তার নাম জপে,

তিনি যে ঈশ্বর!

আদতে যদি তিনি থেকেই থাকেন

মানুষ, দানব, পাখি, পতঙ্গ,

তবে তো একই জান।

শক্তিমান, দুর্বল, ছোট, বড়

বোকা আর চালাকের তফাৎ নেই কোনো।


মণিপুর,

আমাকেও মা বলে

তোমাকে ডাকতে দাও।

তবে তোমার জন্য আমি মরতে রাজি নই।


যদি মৃত্যুই হয় নিশ্চিত,

তারাই মরুক বরং

যারা তোমার সব কিছু শুষে নিল

মিথ্যে চৌর্য শাসানির দ্বারা

সাত প্রজন্মের ধন লুটে নিল

তারা না হয় মরুক তোমার জন্য।

আমি কেন খামোখা মরতে যাব?


আমি মৃত্যুর তিরস্কার

মাথা পেতে নেওয়ার যোগ্য নই,

চারপাশ অবহেলে চোখ বুজে থেকে

আর দীর্ঘ জীবনের আকাঙ্ক্ষায়;

আমার যখন মৃত্যু আসবে

শুধু তখনই মরতে রাজি।


কিন্তু তোমার জন্য কোনমতেই মরতে রাজি নই!






থাঙজম ইবোপিশক - জন্ম- ১৯৪৮। একজন প্রখ্যাত মণিপুরী সাহিত্যিক। দশটি কবিতা সংকলন, দুটি প্রবন্ধ সংকলন এবং একটি স্মৃতিকথা প্রকাশিত হয়েছে। পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, মণিপুর রাজ্য কলা একাডেমী পুরস্কার, ইত্যাদি। বর্তমানে তিনি ইম্ফলের বাসিন্দা।


Comments


bottom of page