মনে হয় শিল্প হল মানুষের সেই অবাধ্যতা, যার প্রতি বিরক্ত থাকে সমাজ। অতঃপর আমরা বুঝে যাই, ধর্মের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কোনও সম্পর্ক নেই। ধর্ম মানুষের তৈরি এমন একধরনের সাহিত্য, যার সাহিত্য অংশটুকুর সঙ্গে পরবর্তী সময়ে যুক্ত হয় অনেকাংশেই মানুষের সৃষ্ট কিছু অনুশাসন। কিন্তু শিল্প কোনও অনুশাসনও মানে না। ফলে, শিল্পের সঙ্গে শিল্পীও পড়ে যান সেই না-মানার দলে। কিন্তু কেন এই অবাধ্যতা, কেন এই অনুশাসন ও শাসন থেকে বেরিয়ে পড়া? কবি তবে কি সমস্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক নৈরাজ্যবাদী সত্তা? কিন্তু সে তো নৈরাজ্যবাদেরও চক্ষুশূল। সে তো কারো কথাই শুনতে রাজি নয়। ক্রমে সন্ধ্যা আসিতেছে তাহার জীবনে। অতএব, সে বুঝে গেছে, জীবনের সহচর কিছু অবাধ্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর সে তাই লিখতে বসেছে একটি কবিতা। কিন্তু, কথা হলো, তাহলে যে বাধ্য অনুগত কবি বা শিল্পীদের দেখছি, তারা? এই তো একদল প্রাতিষ্ঠানিক শাসনে বাধ্য, একদল অপ্রাতিষ্ঠানিক শাসনে বাধ্য, একদল ঈশ্বরের স্বয়ং বরপুত্র, একদল সত্যবাদী, একদল অসত্যবাদী, একদল হিন্দু, একদল মার্কসবাদী, একদল মুসলমান, একদল শূন্যবাদী। সকলেই যে নিজের জগৎকেই, নিজের যুক্তিকেই শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত করতে করতে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে, এ কথা না বুঝেই, যে, সত্য আপেক্ষিক। গোটা মহাশূন্য নিজেকে অবজ্ঞা এবং বিরোধিতা করতে করতে ছুটে চলেছে এমন এক অজানা উদ্দেশ্যহীনতার দিকে, যা সম্পর্কে সে নিজেও জানে না। সে নিজেই সৃষ্টি করছে শূন্যতা, নিজেই ধ্বংস করছে শূন্যতা। তুমি বলবে, এর চেয়ে বড়ো কবিতা আর কাকে বলে! আমি দেখব এক শূন্য চোখের গুহামানবকে, যে কেন গুহার মধ্যে পাথর দিয়ে দেওয়ালে আঁক কষছে , সে জানে না। সে শুধু জানে, যে কোনও সময় একটা ঝড় আসতে পারে। কাঁধে থাবা মারতে মারে হিংস্র শ্বাপদ। সে অনিশ্চয়তা কাকে বলে জানে না, সে জানে না কাকে বলে অমরত্ব। সে মৃত্যুকেও খুব একটা জানে না। জানে, কষ্ট। জানে ভয়। আর জানে, এই গুহার দেওয়ালে তাকে এঁকে যেতে হবে যা সে ভাবছে। হয়তো এই আঁকাগুলিই তাঁর লিখিত অক্ষর। হয়তো এই আঁকাগুলিই তার আত্মজীবনী। হয়তো বা, প্রথম নিরপরাধ কবিতা। আমরা চিনি না তাকে, জানিনা। হয়তো বা ওই বাইসন আঁকার পরমুহূর্তেই শ্বাপদের থাবা তাকে নিয়ে গিয়েছিল বিস্মৃতির অন্ধকারে। হয়তো সে মৃত্যুর অবাধ্য হয়েই ঝুঁকি নিয়ে পাথর দিয়ে এঁকে ফেলছিল তাঁর মন। ভাঙাচোরা আকাশের দিকে তাকিয়ে একবারও ভাবেনি, আমি অমরত্ব চাই, তার পর নশ্বরতা।
পৃথিবীর প্রথম অবাধ্য সেই শিল্পী ও কবিকে জানাই আমার প্রণাম।
এই অবাধ্যতা ছিল বলেই তো আজকের এই টানটান গদ্য পড়ার সুযোগ হল
Besh