এই মাসের কবি : পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
আলাপ পর্ব
আজন্ম জেলা পুরুলিয়ার বাসিন্দা। উদার উন্মুক্ত প্রকৃতির সাহচর্য চোখ মেললেই পান বলে কখনও নিঃস্ব কিংবা নিঃসঙ্গ হন না। নানা ওয়েবজিন ও মুদ্রিত ছোটো পত্রিকায় লেখেন। কবিতার পাশাপাশি গল্প। কিশোর গল্প রচনা করে নিজে খুব আনন্দ পান। প্রথম কবিতার বই, 'নিসর্গের পাশাখেলা'। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেরিয়েছে 'যাপনচিত্র' থেকে। পীযূষের সাথে যোগাযোগ করতে হলে মেল করুন mailofpijus@gmail.com এই ঠিকানায়।
কবিতা
বুক
ঢোলা পাতলুনের মতো এই বড় ফুসফুসে
হাওয়া ভরে সামুদ্রিক হয়ে যেতে হয় কিছুদিন
শাঁখের ভেতর ফুঁ দিয়ে
খরচও করতে হয় এক জীবনের সমস্ত নিঃশ্বাস
নিঃশ্বাসকে বিশ্বাস নেই, বাঁশির ভেতর ঢুকলে
ভৈরবী না পূরবী কী হয়ে যে বেরোবে ঠিক নেই তার
ভীমপলশ্রী রাগে বৃষ্টি না ঝরলেও তো চলবে না,
ধূ ধূ প্রান্তর থেকে এলোচুলে নলকূপের শব্দ উঠে এলেও
তার ঠোঁটে ডুববে না ঠোঁট
আমার বুকের ওপর কান রাখো,
শুনতে পাও,আর্দ্রতার কথা?
দেখো দেখি কোনো কারণেই কি
সে বলতে চায়, সম্ভবামি যুগে যুগে?
আমিও পাই না শুনতে ঠিক তোমারই মতোন
নিজেরই বুককে তাই মনে হয়,
আয়ান ঘোষের মতোই একাকী
আড়বাঁশি
লালগ্রহের উনুনে দূর থেকেও তুমি সান্ধ্য-রুটি
সেঁকে দিলে আমি রাজি; তোমার রুটির মানচিত্র অন্যরকম
বাঁচি মরি এখানে ভ্রমণের খিদে জাগে পর্যুদস্ত হতে
শান্ত নয় কেবলই সর্বস্বান্ত হতে
ঘটমান অভাবে ভাঙাচোরা বৃষ্টি বেচে কখনও
হাত পেতে চেয়েও নিতে পারি ভীমপলশ্রী রাগ;
তারপর ঈশ্বরকণা নামে একটি গবাদি পুষে
লোহিততপ্ত শলাকার মুখে তোমার রক্ত শরীরে পাবো ভেবে
হে অবুঝ নিগ্রহ – নিগ্রো নারী,
চুম্বন-তটে বসে আছি তোমারই নামের দ্রাঘিমা রেখায়
রোদ্দুর আর অন্ধকারের বেড়াল
খোলা খাতায় নিজের পায়ের ছাপ দেখেও আমি বুঝতে
পারি না কোথায় হারিয়ে গেছে আমার ব্যক্তিগত অভিমুখ,
অথচ আস্ত একটি মাছের কঙ্কাল
মাঝে মাঝেই আমার পাতে এসে পড়তে চায়
তার ও তাহাদের একান্ত শয্যাটি অন্য কোথাও
উঠে গেলে
তার তলার অন্ধকারও আমার হয় না কোনোদিন
কাঁটা দেখেই মাছ চিনেছি, রুই কাতলা মিড়িক
কন্টক দেখে ফুলও চেনা যায়। নিগ্রহের বদলে
ভাত চিনতে চাইলেই কি পারবো?
মুড়ো সমেত আস্ত একটি মাছের কাঁটারও
এপিঠ-ওপিঠ বোঝা দুষ্কর,
যেদিকে ঘোরাও একই রকম
আমার হার-জিতও আমি চিনতে পারছি না
না
এইভাবে কাকলি ও কূজনের জন্ম দিয়ে
পাখিরাও আর নেই – তবু অপলাপ নয়
আলাপ রয়েছে এখনও
যখন যে ঘরে রেখেছ পা, বেজে উঠেছে
বাসনকোসন, রোদেরও ঝনৎকার
চাঁদের চিবুক বেয়ে গড়িয়েছে শিশুতোষ জ্যোৎস্নার নাল
ছাপোষা গরামথান, সে-ও তো চেয়েছে নিছক
ধানেরই ফলন – চায়নি তো মোরগের গলা বেয়ে
রক্তের ধানশিষ
জোনাকি-পোড়া প্রার্থনা নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরার অবাধ্যতায়
পিণ্ড দানের কথা ভেবে যেখানেই ছুটে গেছে পৃথিবী,
হবিষ্যান্নের মণ্ড খেতে আসেনি কোনো
কাকেরই অতীতকাল
নির্বাসিত জল
হরিণ সোনার হয় না, সোনার হয় উট
বালিও হিরণ্ময় হতে পারে, চোদ্দ বছরের বনবাস
যা কিছু দেখিয়েছে সে সবই আসলে মরুভূমির অভিজ্ঞতা
কাঁটাগাছের নীচে শুয়ে পড়েছিল উট, তার ছায়া
উটের রক্তপান করেনি; সেই ছায়া যদি বেষ্টন করে থাকে
আমার নিরাপত্তাহীনতাকে, তাকে বলব, রাংচিতার বেড়ার কাছে
এসে দাঁড়ানো ভিক্ষাজীবীর পায়ের ছাপেও যেন কাঁটা না ফোটে
আরো কাকে যেন বলব, চলোর্মিরা জলে ভেসে যায় যাক
বালির সমুদ্রে নিশ্চল ঢেউও দেখতে হবে,
শুকনো সাগর পেরোতে পেরোতে যদি সূর্যাস্ত হয়
উটের পেটের নীচে, যদি তার কুঁজ হয়ে ওঠে স্বর্ণচূড়া,
যাযাবর বিশ্রামের মাঝে নির্বাসিত জল সেখানে
একবার না একবার কেঁদে উঠবেই
এক আকাশের নীচে
বেল পাকলে কাকের কিছুই না, তবু বেলগাছ ভেবে দেখে,
দু-একটা পাকা ফল মাটিতে পড়ে ফেটে গেলে
কাক তো খেয়েও যেতে পারতো
সেই চঞ্চল পাখিটা কোনো রকমে রাতটা কাটিয়ে
ভোর না হতেই ছটফট করতো জেগে ওঠার জন্যে
মরা ইঁদুরেরও অপেক্ষা থাকতো
ওর একান্ত জঠরে গিয়ে কদর্যতা কাটিয়ে ওঠার
নানান মৃত্যুই কাকের প্রাতরাশ
আগের সেসব ঘুম আজকে অনাথ, তাগাদা দিয়ে
ভাঙিয়ে দেওয়ার কেউ নেই
ঝড়ও তো চিরদিন অদৃশ্যই, অথচ ধর্ষিতা ডাল
অনেকগুলি নিষ্পত্র বিকেল আর একদম
একা হয়ে যাওয়া কাক
শুধু পরাক্রান্ত ঝড়ের কথাই মনে পড়াতো
মেঘলা দিনে নাচতে এসে ময়ূরও রক্তমুখী নীলা,
কারা যেন বিকেলের উনুনে হাওয়া দিতে দিতে বলে,
বৃষ্টির শার্সি জুড়ে ছোটো ছোটো রোদের ফাটল,
নিসর্গ এখন টুকরো টুকরো
টুকরো টুকরো
বিশ্বাস হয় না; বরং ভাবতে ভালো লাগে
সব সৌন্দর্যই একান্নবর্তী,
সহস্র নয়নেও তার ভাগ হয় না
বানপ্রস্থ
রামের আংটি দেখেই হনুমানকে চিনেছিলেন সীতা,
শকুন্তলার কাছে দুষ্মন্তের অভিজ্ঞানও অঙ্গুরীয়ই
মেঘলায় ডুবিয়ে হাত আমিও খুঁজছি
রোদের স্মারক, আঙুলে জড়ানো আলোকলতা
বোগেনভিলিয়া চিনলেও পুটুস ফুলের ঝুড়
চিনতে পারছি না; সমাগমের ভেতর ফ্যালফ্যাল
করে চেয়ে আছে জারজ নিঃসঙ্গতা, তার মাথায়
ঝরে পড়ছে উল্কার ছাই, শীতল হাওয়ার কুচি
জোনাকির ধূপ পুড়ে গেল, তন্দ্রার ভেতর
আমি পেলাম গৃহবাসী এক গন্ধ
দুয়ারের এঁটোকাটা রুগ্ন কুকুর দেখেও
আমি কি চিনতে পারবো আমার ঘর?
আকরিক
মৃত্যুর পরে সবচেয়ে বড়ো দুষ্কৃতীরও নামের মাথায়
জ্বলে ওঠে একাকী সন্ধ্যাতারা; বঙ্কিম কটাক্ষে, চাঁদ
মানুষটির কুকীর্তিগুলি ট্যানা পরে নানান অন্ধকারে লুকিয়ে বেড়ায়,
একান্তে তারা প্রতিদিন কোনো না কোনো গাছের কথাই ভাবে,
প্রয়াত ঘুলঘুলির ভেতর দিয়ে চেয়ে থাকে বৃক্ষ-শীর্ষের দিকে
কেন যে এত ভয় এত দেখার ভুল
বুকে পড়ছে হাতুড়ির ঘা, দৃষ্টিটাই হয়তো টুকরো টুকরো হয়ে
চাঁদকে ভেঙেছে নীরব কণায়
একমাত্র মাটিই আগাগোড়া জ্যান্ত, তার মৃত্যুর শংসাপত্র দিতে
তারাদেরও রজত রঙের শিলমোহর ছাই হয়ে ঝরে যায়
মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায় কিছু কিছু স্বর্গের আকরিক
প্রাচীন
৯০/৯১ সালে গজবীথির মতো যুবারা আসতেন
একটি ছাতিমতলায়, পরস্পরের জন্মদিন পালন
নক্ষত্রের ফিসফিসানি আর ষড়যন্ত্রে প্রতি সপ্তাহেই
কারুর না কারুর জন্মতিথি
আমাদের ভালো ঘর নেই, নেই একটা বসার জায়গা
অথচ রক্তে ছিল বাহির বারান্দা আর দরদালানের মাঝামাঝি
ভুতুড়ে প্লাটফর্মের মতো রহস্যে ধোয়া ঝকঝকে একটা নিকেতন,
মাঝের আকাশ অনিকেত, সেখানে কুয়াশার দিকে
তীর তাক করে শীতের কালপুরুষ। তার নামকে কেউ ক্ষয়িষ্ণু
হতে দেখে না, তার শরকে দেখে না ভোঁতা হয়ে যেতে
ভেবেছি, এই বুক কেন পায়রার বুকের মতোন মাঝে মাঝে
হ্রস্ব ও আতুর হয়ে আসে; তিনি নিয়ামক, যেদিকেই বৃষ্টি ফোটান
ভিজে যায় চকবাজার – কালীতলা লেন, পোস্টাপিস বাড়িটি
আরো বিবিক্ত আরো অন্তিম-ঘেঁষা হয়ে যায়, ছোট্ট লকেটের মতোন
বুকের কোনখানে একটা কান্না লুকানো থাকে, খুঁজে কি পাবো ছাই!
নগর সংকীর্তনের চেয়েও দীর্ঘ হলে এই ধারা-বর্ষণ,
উন্মাদ হয়ে ওঠেন আরো খানিক বিষদ, আরো একটু আলাপী
মনে মনে তাঁকে বলি, ডাকবাক্সের নীচে অকারণ অপেক্ষার
নিগ্রহে ভিজেছেন এতদিন, এবার কিছু খড়কুটো নিয়ে
চড়াই পাখি হওয়ার সময় হলো আপনার
আমাদের সেই কথাও কালপুরুষের চেয়ে পুরোনো হয়ে গেছে
নিমগাছ
নক্ষত্রের নামে কেন এত নিমফুল ছড়ালে বেনামে?
মুখের আদলে আমারও চাঁদ দেয়নি ধরা,
পিছলে গেছে মেঘ-শৈবালদামে
কে যেন এক জনৈক আশ্চর্য, ভেবে দেখে,
একই তো সূর্যের আলো, তবু সূর্য থেকে আসা আর
চাঁদের গা বেয়ে কত তফাৎ। কাছে থাকতে দিলে না কিছুই
একই জাহাজের ডকে লোনা হাওয়া দু-জনের দুই নিঃশ্বাস হয়ে
রয়ে গেল পাশ ফিরে
সুদূরবর্তী বিরহে কেন তবে সমস্ত মেছো ঘ্রাণ লুপ্ত হয়ে যায়
কেন মাছ ধরবার জালে তারাদের ধরতে লাগে আনন্দ বেশি
অগ্নিনির্বাপনকে বিকল করে ডাঙায় উঠেছি বহুদিন দিন পরে
পলাশী দিগন্তে চেয়ে আজ শুধু শাক্তপদের পদচারণা
যেভাবে রণপায়ে হুঙ্কার ছাড়ে ঝাঁকড়া চুলের ডাকাত,
অথবা চরণ-কমল আজ ধরতে পারি বুকে
মনে থাকে না সে-ও তো এক পুষ্পই, অথচ
তন্ন তন্ন করে খুঁজি বুক, কোথাও কোনো ফুলের কেয়ারি নেই
সে কোথাও নেই – কোত্থাও নেই
রঙিন বসন্তের পরে, বৈধব্যদশায় গোটা নিমগাছ জুড়ে
ছড়িয়ে পড়ছে তিক্ত অভিজ্ঞতা