এই মাসের কবি : মৃণালকান্তি মাহাত
আলাপ পর্ব
জন্ম- ১৯৮৮ সালের ৮ই মে। জঙ্গলমহলের এক প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা। পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনী ব্লকের মধুপুর গ্রামের বাসিন্দা। বন, পরিবেশ ও আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক।কবিতা চর্চার পাশাপাশি, গল্প ও প্রবন্ধ রচনাতেও সমান আগ্রহী। জঙ্গলমহলের প্রান্তিক মানুষ, তাদের সংস্কৃতি, পরিবেশ, প্রকৃতিই লেখার বিষয়। সাংবাদিকতা দিয়ে লেখার জগতে প্রবেশ ঘটলেও, এখন সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও ভালোলাগা রয়েছে। সম্পাদনা করেছেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের পত্রিকা 'May Fair'। এছাড়া পশ্চিম মেদিনীপুর এর বেশ কয়েকটি ছোট পত্রিকার প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ডিবরির আলোটা উস্কে দাও(২০২০), যাপনচিত্র। ইমেল- mrinalkanti.mahata12@gmail.com
কবিতা
মহুল বিহা
আমি মহুল কুড়োতে যাইনি, মহুল আমাকে টেনে নিয়ে এসেছে
তাঁর সঙ্গে আমার কত জন্মের সম্পর্ক
মহুল আমার কে হয়? ঠাকুর্দা, বাবা বা অন্য কিছু?
সতীন এর পুংলিঙ্গ কি হয়, জানা নেই
তবে সেই সম্পর্কও মহুল আমার আত্মীয়,
শত্রুও যদি ভাবো ,তবে তাই-
আজ থেকে আশি বছর আগে আমার ঠাকুমা প্রথম বিয়ে করেছিল মহুল গাছকে
পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমার মা
মাত্র তিনবছর আগে আমার স্ত্রী ছামড়া তলায় বসেছিল মহুলগাছের পাশে
শুনেছি, ঠাকুমার ঠাকুমাও মহুল গাছের স্ত্রী
তাই সহস্র বছর আগের পুরনো কুটুম্ব এই মহুল
তার টানেই ফিরে আসি মহুলতলে, গান গাই, গল্প করি
ঝালাই করি পুরনো বন্ধুত্ব
মৃত্যুর পর একদিন-
এই মহুল তলেই তো মিশে যাবে জীবন
একসঙ্গে কাল কাটাবো সত্য, ত্রেতা,দ্বাপর, কলি---
সঞ্চয়
আমি আমার ভেতর আস্ত একটা সূর্য রাখি
আলো সঞ্চয় করে রাখি আলুভেলির গর্ভে
কিছুটা ছড়িয়ে দিই ধানবিলে বীজতলার ভেতর
কিছুটা গুছিয়ে রাখি অম্বুবাচির জন্য, যেদিন পৃথিবীর শরীর খারাপ হয়
কিছুটা তুলে রাখি কুলুঙ্গির তাকে
যদি ভাদৈরা টান আসে কোনদিন
কিছুটা জমা রাখি মায়ের খুঁটে যদি মনখারাপ আসে কখনো
বাকিটা বুকের ভেতর বাম অলিন্দে
আমার অনাগত সন্তান সন্ততির জন্য
যারা ফসল হয়ে বেঁচে থাকবে পৃথিবীর জন্য
শত শত বছর
শেষ ভগ্নাংশ তুলে রাখি শেষ দিনটির জন্য
যার আলো আমাকে পোঁছে দেবে করম রাজার দেশ
ডুমুরগাছ, গোরুর বাথান, পুকুর আর কুমিরের আদ্দাশ নিয়ে যাব কর্মু-ধর্মুর সাথে
টুসু ৪
টুসুকে আমি দেখিনি, কুলির রাস্তায় দেখেছি তার লক্ষ্মী ছাপ
ডুংরির পথে শুনেছি টুসু গান
কুমারী মেয়ের পায়ে পায়ে যা হেঁটে এসেছিল শালের ছায়ায়
ঘাম হয়ে ঝরে পড়েছিল পাতার উপর টুপটাপ; আর-
ক্লান্ত রমনী আঁচলে বেঁধে নিচ্ছিল এক একটা ধারাপাত
মাড়ভাতের আঁকিবুকি
আমি তখন বালির উপর আঁকি একটা মানবীর মুখ
যে কোনদিন ধরা দেয়নি দু'চোখের বাঁধনে
দূর থেকে শুনিয়ে গেছে বড়ু চণ্ডীদাস শুধু
মকর লইজকায় আসে, আমিও আঁকতে বসি । আশ্চর্য-
ধরতে পারিনা সেই মানবীর মুখ , বরং
ক্যানভাসে ফুটে উঠে হাজারটা মানভূম রমনী
যাদের সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছিল কুমারী নদীর ধারে
লালগড়ের হাটে কলমি বেচতে এসেছিল যে মেয়েটা
পরকুল মেলায় যার নাচ দেখে বুকে এসেছিল হড়কা বান
ক্যানভাসের উপর সবাই উঠে বসে একে একে
আঁকতে পারি না টুসুর মুখ
ডিবরির আলোটা উসকে দাও
কাঁসাই-এর বুক চিরে নেমে আসছে সহস্র অন্ধকার
লুলকির মা, ডিবরির আলোটা উসকে দাও
যত ধারালো কুঠার জেগে উঠুক ঘুম থেকে
বাঁধআগালের নীচে অপেক্ষা করছে ভিনদেশী বাগাল
যারা একদিন বলেছিল, খাপরার ঘর জুড়ে নেমে আসবে
চাঁদের আলো
খিদের জ্বালায় পিঁপড়েরা আর আত্মহত্যা করবে না
লুলকির মা, ডিবরিটা উসকে দাও
সামনে ভোট পরব-
লাউমাচায় এসে বসছে লাল, নীল, সবুজ, গেরুয়া পরিযায়ী
যাদের ঠোঁটে এতদিন রক্তাক্ত হয়েছে যত আইনের বই
সংবিধানের লাশের উপর গড়ে তুলেছে বর্গা আইন
লুলকির মা, ডিবরিটা উসকে দাও
কাঁসাই এর উপর নেমে আসছে সহস্র অন্ধকার।
অরণ্যের গ্রাম
অরণ্যের বুক চিরে যে মোরামের পথ গ্রামের কাছে নতজানু হয়,
তার নাম দিয়েছিলে কিশোরী
তার শরীর রাঙা লালরং একদিন
গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা জন্ম দিয়েছিল কবির গর্ভে
মহুয়ার নেশায় রুনুঝুনু ঝুমুর গীত
তুমি সেদিন মাতাল
তুমি প্রেমিক
আজ কিশোরীর শরীর জুড়ে সাজানো মাইন
বৈধব্য নিয়ে বেঁচে আছে কুড়মী গ্রাম
বড় অসহায় ঝুমুর গীত
দূরদেশে নামাল খাটে ঝুমৈরা নাগর
মাদৈলা আজ তাল হারায় বনপার্টির ভয়ে
জেগে থাকে অরণ্য এভাবেই
ধর্ষিতা রমণীর পাশে আদর্শ নাগরিক হয়ে।
কবিতার নায়িকা
কবিতা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হলে আমি ফিরে যাই মেঠো নদীতটে।
আঁজলা ভরে তুলে নিই ফসলের একাকীত্ব।
হাঁটু জলে নেমে অনুভব করি নদীদের গান। কোন বৈশাখে পায়ের শুক্তি ভিজিয়ে দিয়েছিল গ্রাম্য বালিকা, আঁচলে বেঁধে ছিল ছোট ছোট ঢেউ । লুম্পেন চাষীর দল লুটে নেয় ফসলের সতীত্ব। দু:খে কত রাত ঘুমোতে পারেনি আউশ-আমন।
এইসবই বলেছিল নদী।
চাষীর গান কেন কবিতা হল না? খড়ের চালিতে বসে যে বৌটা সারাদিন রান্না করে, বরের জন্য বাইসাম নিয়ে যায় বাবলার ছায়ায়, দিকশূন্যপুরে খুলে দেয় হৃদয়ের খুপরি, আজও কেন নায়িকা হতে পারল না কবিতার খাতায়?
শান্ত জলাশয়ে একটা পাথর ছুঁড়ে দিয়ে ছিলাম। উত্তর দিতে পারিনি। নদীর জলে তখন ভেসে ওঠে একটা মুখ। একটা স্বার্থপর মুখ। যে কোনোদিন নিজের কাছেই কথা রাখতে পারেনি।
বাঁদনা মঙ্গল ৬
বুলানের জলে সাঁতার কাটে লাঙল-জোয়াল
হেমন্তের রোদ বানায় অস্থায়ী উনুন
আজ গরৈয়া
ভিজে গামছা গোয়ালে অষ্টাঘর আঁকে
পরম যত্নে চালগুঁড়িতে আঁকা বাৎসরিক প্রার্থনা
ভাল থাকুক দুধেল গাই
ভাল থাকুক কালু বলদ
ভাল থাকুক ভাদোশোল
ভাল থাকুক ঈশান কোণের গরাম থান
সংসার আজ ভাল নেই
বুকের ভেতর পুঁজ নিয়ে অসুস্থ শালুকফুল
মাটি মা-এর জন্য আরেকবার উপোস করে বড় বৌ
আজ গরৈয়া ।
বুড়াই
হামি বছর বিয়ানী মা
হামার স্তনে বেঁচে থাকে গ্রামের পর গ্রাম
মহুলতলার ভাতঘুম
হামার চলার পথে হাঁটে কিশোরী নূপুর, বাগালিয়া সুর
অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছি ছিপবাঁধা জীবন
অভাবী বিকেল খোঁজ নেয়নি
কিভাবে হামার ঋতুস্রাবে পুষ্ট তোদের ধানক্ষেত
চাষার দল আজ শরীরে ঢালে ক্যানসারের ভ্রুণ
হামার যোনি বিক্ষত করে নিয়ে যায় ভাতের থালা
ভালবাসা আজ ক্লান্ত
অপেক্ষা করি হড়কা বাঁধ নিয়ে ফিরে আসবে কাঁসাই
আবারও একদিন অষ্টাদশী বুড়াই।
পুনর্বাসনের বাইক
মাইন-এর হাতে খুন হলাম বলে
আমি হলাম চর, বিশ্বাসঘাতক
মর্টার-এর হাতে শেষ হলে বলে
তুমি হলে বিপ্লবী-শহীদ
আজ অরন্যের গাছ হয়ে গেছি দুজনেই;
দেহের উপর হেঁটে যায় আমার বিধবা সাইকেল
ফুলের হাওয়ায় উড়ে যায় তোমার কমরেড,
পুনর্বাসনের বাইক ছুটে চলে সরকারি ভাতায়-
যে সাইকেল ফিরে আসেনি
সবাই ফিরে এল একে একে
যত গোরুর পাল ফিরে এল বাথানে
আড়বাঁশি মাঠ থেকে আশ্রয় নিল বাগালের কুলুঙ্গিতে
মুনিষ কামিন সন্ধ্যার অধন বসাল রান্নাঘরে
চাষিবউ শাঁখ বাজাল সন্ধ্যায়
যত মাইন মর্টার বিশ্রাম নিল গেরিলা যুদ্ধে
বিপ্লবীরা ফিরে গেল সরকারের ঘরে
লালগড়ের পরবহাট থেকে
শুধু ফিরে এল না পুরোনো একটা সাইকেল
ঘরে এল না টুসুর ফ্রক, সাধের ছাপাশাড়ী
চপচপে সিঁদুর পরে অপেক্ষা করে রাতের লন্ঠন
বুঝি এই এল সুজন-
সুজন তখনও নিখোঁজ পুলিশের খাতায়
তাঁর ছেঁড়া লুঙ্গি জেগে আছে বিপ্লবের জীবাশ্ম হয়ে
হেরে যাওয়া মাইনের সাক্ষী হয়ে।