এই মাসের কবি : কল্পোত্তম
আলাপ পর্ব
উত্তম মাহাত, জন্ম ১৯৮৩ সালের ২ জানুয়ারী পুরুলিয়া জেলার বলরামপুর থানার অন্তর্গত বেড়াদা গ্ৰামে। ২০০৩ সাল থেকে উত্তম মাহাত নামে লেখালেখি করলেও ২০০৬ সালের পর থেকে কল্পোত্তম নামেই লেখালেখি বা আঁকাআঁকি করে থাকেন। পেশায় রাজমিস্ত্রি উত্তম মাহাত ইতিমধ্যেই "সাতরঙা পাড়" নামে একটি কাব্যগ্রন্থ, "রিঝে রঙে" নামে একটি ঝুমুর সঙ্গীতের বই, "পেইন্টেড ট্রেন" নামে একটি উপন্যাস ও "স্বপ্নসিঁড়ি" নামে একটি গল্পগ্ৰন্থ প্রকাশ করেছেন এবং খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হতে চলেছে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ "বত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক"। লেখালেখির সাথে সাথে ছবি আঁকা ও সিমেন্টের আর্ট ওয়ার্ক করতেও ভালো বাসেন তিনি।
পুরুলিয়া থেকে প্রকাশিত "অরন্ধন" ওয়েব ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক হিসেবেও অসামান্য কাজ করে চলেছেন তিনি। এছাড়াও যুক্ত রয়েছেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবি দীপংকর রায়ের "এবং কথা"-র সম্পাদক মণ্ডলীতে।
কবিতা
কৃষিতন্ত্র
২৫.
পাখির ঠোঁট দিয়ে
ছড়িয়েছো বীজ
পাখির ডানা দিয়ে
ছড়িয়েছো হাওয়া
নিত্য আসা যাওয়া
অলিতে গলিতে
পাখিটির তাই।
উঠোনের একপাশে
মাটির পরতে ঢেকে
ভিজিয়ে ভিজিয়ে
যতনে রেখেছি তাকে
অঙ্কুর হবে বলে
স্বপনে গেয়েছি গান
পাখির বাসায়।
স্বপনে বৃষ্টি ঝরে
আলগা হয় মাটি
গভীরে প্রবেশ করে
জীবের শেকড়
রোদ ঝড় কুয়াশাতে
অঙ্কুর জাগিয়ে রাখি
পার্থিব আশায়।
২৭.
লাঙ্গলের ফলা
ভিনগ্ৰহে যাওয়ার পথ আমাদের
লাঙ্গলের ফলায় মহাকাশের শকট
এক শূন্যতা থেকে আরেক শূন্যতার দিকে
ধাবিত হওয়ার একমাত্র উপায়।
মাটি আলগা করার,
শেকড় প্রোথিত করার
আদিম এই রীতি
অনাধুনিক ছিল না কখনো।
শেকড় মাটিতে রেখে
তোমার এই জীবন সন্ধান
ভিনগ্ৰহে
আরও এক শেকড়েরই খোঁজ।
অন্ধকার নয়
আলোতেও নয়
আমাদের হাঁটাচলা
এ দু'য়ের মাঝখানে
উপছায়া বরাবর সীতা-সঙ্গীতে।
২৮.
বাঁচতে গেলে ধুলো মাখতে হয়
মাখতে হয় ধানের গুঁড়ো
ধুলো গুঁড়ো ছাড়া জীবন কোথায়?
বাঁচতে গেলে কাদা মাখতে হয়
মাখতে হয় ঘাসমাটি
কাদা ঘাসমাটি ছাড়া শস্যহীন আঁচল।
বিবাহ মঙ্গলের পর জল-কাদা মেখে
ধুলো উড়িয়ে
নিয়ে আসি শস্য মঙ্গল।
শস্য মঙ্গল
আমাকে মঙ্গলামঙ্গল পার করে
নিয়ে যায় অন্ন মঙ্গলের দিকে।
২৯.
মাটির কাছে বসবাস আমার
মাটির কাছে ঘর
প্রতিদিন হেঁটে যাই মাটির দিকে
অঙ্কুরের দিকে। বীজ থেকে
প্রথম বেরিয়ে আসা কচি পাতার মাথায়
মাটির আস্তরণ, আটকায়
অহেতুক উষ্ণতাকে।
মাটির আস্তরণের তলায়
শুয়ে থাকে জীবন
মাটির আস্তরণের তলায়
শুয়ে থাকে আগুন
তাকে জাগাতে পারলেই আগ্নেয়গিরি
তাকে জাগাতে পারলেই
শিষ আশিসের স্পর্শ।
মাটিই লাশ মাটিই উল্লাস
চলন বলনের আধার
জঙ্গমের প্রাণনাথ
প্রবাহের সুষ্ঠু ধারক
তাকে জাগাতে পারলেই
অমূল্য প্রাণ প্রবাহের নদীচরে সবুজ
তাকে জাগাতে পারলেই
সমুদ্র মন্থন, অমৃত।
৩০.
গ্ৰীষ্ম অবকাশে
চেয়ে থাকি আকাশের দিকে
চেয়ে থাকি চাতক,
শরৎ অবকাশে
চেয়ে থাকি মাঠের দিকে
চেয়ে থাকি দুধভরা শিষ।
ধান গাছের চারপাশ থেকে
আগাছা না সরালে
বৃদ্ধি হয় না ধান গাছের
হয় না সমৃদ্ধি। বার বার দেওয়া
জৈব অজৈব সারে
বেড়ে ওঠে নলখাগড়া।
তুমি কৃষক। তোমাকে জানতে হবে
ঠিক কোন আদর্শ সময়ে
কার রথের চাকা মাটিতে বসিয়ে দিলে
কার ঘরে উঠবে স্বর্ণশিষ।
৩১.
পথিকের পায়ের তলায়
তৈরি হয় পথ,
পথেরও আগে
পথিকের হাঁটাচলা।
যে পথে শস্যবীজ
সেই পথে পথিক হেঁটেছে,
হেঁটেছে কৃষক
মহাকালের চরকা হাতে।
মহাপ্রলয় থেকে
মহোৎসবের দিকে
পৃথিবীকে নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা নিয়ে
জন্ম হয় কৃষকেরই;
কৃষকই পারে
তিন বেলা দাউ দাউ জ্বলে ওঠা
আগ্নেয়গিরির
আগুন নেভাতে।
৩২.
মাটিও মানুষ চেনে, চেনে
কে তার বুকের সুধা
বয়ে নিয়ে যায় প্রজন্ম পেরিয়ে
কে তার বুকের সুধা
তুলে দেয় বুদ্ধের হাতে।
এক এক শস্যে এক এক শিষ
এক এক শিষে অনেক শস্য
অনেক অঙ্কুর, মাটি ফুঁড়ে
এগিয়ে যায় জলের দিকে
এগিয়ে যায় জীবনের দিকে।
জীবনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথরেখা
তুমিই আঁকতে পারো
তুমিই বাঁধতে পারো
চরৈবেতির গান মহোল্লাসে।
মাটির দিকে তাকাও
সে কিছু বলতে চায় অস্ফুটে
সে কিছু দেখাতে চায় নিভৃতে
মাটির কাছেই বোধিসত্ত্ব লাভ।
৩৩.
একটু একটু করে
ছুঁয়েছো আকাশ গঙ্গা
একটু একটু করে
ছুঁয়েছো তারাদের কাঁধ,
আমার দিকে তাকালে
অনেক নিচে দেখতে পাও আমাকে।
যত উপরেই যাও
মাঠিই তোমার আধার
যত উপরেই যাও
আমিই তোমার আধার
যুগ যুগ হেঁটে যাই আমি
লাঙ্গল কাঁধে। তোমার চৌহদ্দির
চারপাশে রক্ষাকবচ, পতপত রঙিন পতাকা
আমার পাঁজরে গাঁথা।
মাটিতেই গাঁথা থাকে পা আমার
তাই আমি উড়ি না কখনো
তুমি রোজ ছুঁতে চাও তারাদের দেশ।
মনে রেখো, যত উপরেই যাও
মাটির কাছেই ফিরতে হবে একদিন।
৩৪.
হাওয়ার গতি দেখে বুঝে যাও তুমি
খড়ো চালের ভবিষ্যৎ
হাওয়ার অভিমুখ দেখে বুঝে যাও
মৌসুমের বৃষ্টি সম্ভাবনা
তারপর হিসেব নিকেষ শেষে বীজ বোনা
রহিনের গোড়ায় গোড়ায়।
অঙ্কুর প্রথমে হলে প্রথমে ফসল
প্রথমে আমন হলে রবিও প্রথমে
খাত থেকে জলধারা শুকোনোর আগে
চৈতালি ঘরের মেঝেয়।
গৃহে এলে চৈতালি
গৃহে থাকা সারাটা দুপুর
গ্ৰীষ্মের পিঠফাটা রোদে
মেতে থাকা প্রাচীন খেলায়।
কখন বপন করে বীজ
কখন ফসল আসে
সেকথা শেখাতে হবে আরও
বিকেল বেলায়?
৩৫.
নজরে পড়তেই ছুড়ে ফেলো কীট
নজরে পড়তেই সরিয়ে দাও তাদের
যে ডালে আশ্রয় নেবে
সে ডালেই দাঁত বসাবে
ঝাঁঝরা করে দেবে পাতাদের।
কত রঙের কীট, কত রকম চরিত্র,
মুগ্ধ হয়ো না। রঙের আড়ালে হুল
তোমারই প্রতীক্ষায় রাতদিন।
ফসলের গায়ে কালসিটে
গঠন বিবর্তনে অহেতুক পরিবর্তন দেখে
বুঝে যাও, কামড়ের দাগ।
সজাগ হও, নজরে নজরে রেখো
দেখো, কোন্ পথে আনাগোনা
কোথায় নিয়েছে আশ্রয়।
আড়ালে করবে ক্ষতি
চিরচেনা এই তার ধ্রুপদী পরিচয়।
৩৬.
চাষ করতে হলে
বুঝতে হবে আবহাওয়া
বুঝতে হবে মাটির চরিত্র,
কোন্ মাটির জলধারণ ক্ষমতা কতটুকু।
মাটির রং, কমনীয়তা দেখে
জানতে হবে মাটির জাত
জানতে হবে পূর্বাভাস
ফলন শক্তির। তারপর
নিজের মতো করে মাটি তৈরি করে
ফেলতে হবে বীজ সঠিক ঋতুতে
দিতে হবে জল, আনুমানিক
হিসেব নিকেষে। তোমার দক্ষতার ওপর
অঙ্কুরের শিকড় বিন্যাস
তোমার দক্ষতার ওপর পরিপুষ্টতা ফসলের
তোমার দিন যাপনের সহজ হয়ে ওঠা।
মাটির কাছে যাও। মাটি চেনো। স্পর্শে স্পর্শে
পাল্টে দাও চরিত্র।
অনাবাদ যোগ্য মাটিও
আবাদ যোগ্য হয়ে ওঠে
সুললিত কর্ষণের গুণে।
৩৭.
আদিম গন্ধ আছে মাটির ভিতর
এই তার পরিচয় আদিমতার
এই তার পরিচয় সরলতার
এই তার সংযোগ আগুনের সাথে
সৃষ্টিশীলতার।
আগুনের আঁচ নিতে
শেকড়ের আনাগোনা বুকের ভিতর
পাঁজরের মতো,
লাঙ্গল করেছে অনুভব
সীতা সৃষ্টির কালে
অঙ্গভাঙ্গা টান।
বলদ আর শেকড়ের মাঝে
সৃষ্টিশীল কাজে ভেঙ্গেছে লাঙ্গল।
মোহ ছেড়ে, বেদনার আস্তরণে মুড়ে
রেখেছে নিজেকে
যথা সম্ভব হাসিটুকু দেবে বলে
প্রান্তিক কৃষকের খোড়ো চালে বাসা বাঁধা
চড়ুইয়ের ঠোঁটে, দেবে বলে উজ্জ্বলতা
সে বাসার গৃহিণীর বাসন কোসনে।
৩৮.
কৃষিজমির মাঝে পাথর এলে
ভেঙ্গে দিতে হবে। ছুড়ে ফেলতে হবে দূরে।
এভাবেই মজবুত করো নিজেকে
এভাবেই মজবুত করো লাঙ্গলের ফলা
প্রতিস্থাপন করো বীজ মাটির গভীরে।
জীবনের পরিচর্যায় জৈবরস অপরিহার্য
অপরিহার্য পরিকল্পিত অপরিকল্পনা,
আমার পরিকল্পনার উপর
যে পরিকল্পনা রূপায়িত হয় তোমার
তাকে মানিয়ে নিতেই
অপরিকল্পিত পরিকল্পনা গ্ৰহণ আমার।
আমার পরিকল্পনার বাইরে খরা, বন্যা
ঝড়, ঝঞ্ঝা, বিদেহীর গমনাগমন
তোমার পরিকল্পনার মধ্যেই
ভূমন্ডলজুড়ে চলাচল এদেরও।
তোমার পরিকল্পনার মধ্যেই যোগ বিয়োগ
অপত্যের যাতায়াতে সাজানো বাগানে।
৩৯.
ডান হাতে নাই বা দিলে
বাঁ হাতেই দাও
নিজের সপ্তডিঙা, সাজানো বাগান
রাখতে চাও যদি, অক্ষত
আগের মতোই।
বাঁ হাতেই দাও যদি
পূর্ববৎ চষে যাও ক্ষেত, বানিজ্য করো
উৎপাদিত ফসলের ধারাপাতে।
সকলকেই শিখিয়ে দাও
নবগ্ৰহের কথা। শিখিয়ে দাও রাশিমালা
বিনা সংকোচে। বলে দাও
বাঁ হাতেই দাও যদি
চারপাশের ফণাধারী সব
ফোঁসফোঁস করলেও ছোঁবে না কখনো।
৪০.
মাটির কাছে থেকে দেখেছি
পোড়া রোদের প্রলাপি পতন
দুপুর পেরিয়ে।
মাটির কাছে থেকে দেখেছি
ফুলেদের ফল হয়ে যাওয়া
গোপনে গোপনে।
তোমার আমার মাঝে, যে
স্বত্ববিলোপ নীতি ক্রিয়াশীল
প্রতি ক্ষণে ক্ষণে,
সে নীতির ধার ঘেঁষে উড়ে যায়
শস্য বীজ, উড়ে যায় সফেদ কপোত।
স্বত্বের কি প্রয়োজন?
প্রয়োজন ফসল, প্রয়োজন চষা মাটি
লাঙ্গল-কোদাল, জলাশয়
সমস্ত সুখ দুঃখে ঢুবতে পারে
এমন ডুবুরি। কখনো কখনো
প্রাণপণ আঘাতেও অনুভূত হয় সুখ
অনুভূত হয় ভঙ্গিল পর্বতের জেগে ওঠা।
৪১.
জমির প্রকৃতি দেখে বপন করি বীজ
ধারণ ক্ষমতা দেখে সিঞ্চন করি জল
তারপর দিয়ে থাকি লালন পালন।
তুমি জানো, সমতলের সরলতা
মালভূমির জটিলতা আর
পাহাড়ি জটিলতার বিস্তর ফারাক
সেই ফারাক বুঝে
বুঝে নিতে হয় কোন্ বীজ কোথায়
অধিক ফলনদায়ী হবে।
কোন্ বীজ কোথায় ফেলে
সফল হবে চাষির জীবন।
নজরে নজরে রেখো
ক্ষতিকর কীট যেন না পারে মুখ দিতে
নজরে নজরে রেখো
পাতার কুঞ্চন যেন না হয় গাঢ় শীতে
উদ্ভাবন হোক যত ওষুধের
থাক যত উদ্ভাবক কৃষিযন্ত্রের
শস্যের সামাজিক দায়ভার
শেষমেষ নিতে হবে চাষিকেই।