top of page

এই মাসের কবি : ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত

IMG-20200829-WA0010.jpg

আলাপ পর্ব

জন্ম ও বেড়ে ওঠা কলকাতায়। ইঞ্জিনিয়ারিং করে বর্তমানে কলকাতাতেই বহুজাতিক আইটি সংস্থায় কর্মরত। চাকরি সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করতে হয়েছে। মুম্বই, হায়দ্রাবাদ, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশে আতিবাহিত জীবনযাত্রার ছাপ কবিতায় মেলে। স্কুল জীবনে ক্লাস সিক্স-এ প্রথম কবিতা লেখা। চাকরির ফাঁকে বাংলা ও ইংলিশে কবিতা লেখা, আবৃত্তি করা, তবলা বাজানোয় শখ রয়েছে। ‘আনুষঙ্গিক’ নামক একটি বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের সাথে সরাসরি যুক্ত। এছাড়াও বিভিন্ন বাংলা ও ইংলিশ ম্যাগাজিনের সাথে লেখালিখির সাথে যুক্ত। ইন্দ্রনীলের সাথে যোগাযোগ করতে হলে মেল করুন indranils58@gmail.com

কবিতা

ফাঁকি

 

যে শহরটা ছেড়ে এসেছি

তাকে দেখা যায়

যে ভাষাটা ফেলে এসেছি

তাকে শেখা যায়

যে ইট পাথরগুলো রেখে এসেছি

তাদের ছোঁয়া যায়।

যে স্মৃতিগুলো ফেলে এসেছি

তাদের ফিরে পাওয়া যায়।

কিন্তু

যে আষাঢ়ে আমি ভিজে এসেছি

তাকে আর পাওয়া যায় না।

যে মেঘগুলোকে আমি ডেকে এসেছি

তারা সব রং পাল্টেছে।

এতই বর্বর এই সভ্যতা।

 

 

 

 

 

 

ভাবো

 

কালচে নারকেলগাছটার নীচে

পড়ে যাওয়া পোড়া বাসাটায় খুঁজে পেলাম

কয়েকটা লেখার পাতা,

সাদা পাতাগুলোয় লেপ্টে রয়েছে কালো দাগ।

যেভাবে গণতন্ত্রের নামে আদিবাসী ভোট দেয়

ভরপেট খেয়ে একটা দিন ভালো থাকে,

যেভাবে হর্স ল্যাটিট্যুডে শুধু ঘোড়া চটে যায়,

সেভাবেই দাগ পড়েছে পাতায়। শান্তভাবে।

বাজ পড়েছিল। ম্যানমেড।

প্রায়ই এরককম বাজে পড়ে। সভ্যতার বাজ। আশীর্বাদের বাজ।

আর হাওয়ায় উড়ে গাছে আশ্রয় নেওয়া প্রতিবাদগুলো এভাবেই ঝলসে যায়,

দাগ লাগায় সভ্যতার স্যুটে।

মাটিতে মিশে এপিক রচিত হয়।

আর প্রজন্মের তৃতীয় ছানা সেই এপিক দিয়ে দুর্গাপুজো করে সেই হর্স ল্যাটিট্যুডেই,

একটা পাতাও না পড়ে।

কবে পড়া হবে সামান্য প্রচ্ছদের লেখা

'ভাবো'?

-তোমার ওপর ছেড়ে দিলাম।

 

 

 

 

 

 

বসন

 

এই হালকা শীতের নিশি রাত একটু মন্থর,

পোহায় দেরিতে।

একটা কাটা গুঁড়ির পাশে বসে থাকি আবছা আলোয়।

যে পথে সভ্যতা এসেছিল এই রাতের ছোঁয়া পেতে

সে রাস্তায় কবিতা যতিহীন, মাত্রাহীন।

রাত সহজে বাড়ে না

পাহাড়ি অচেনা গাছগুলো হাত বাড়িয়ে বসে থাকে।

মোড়কের পরিহাসে বেশ কিছু প্রহর পেরিয়ে যায়-

অচেনা গাছগুলোর পাতার সাজের মোড়ক,

সংজ্ঞাহীন রাস্তার রক্ষাকবচ।

প্রতিটা কাব্যগ্রন্থ আজ এই মোড়কে আচ্ছন্ন।

প্রতিটা কবিতার স্ট্রিটলাইটের তলায়

সভ্যতা বস্ত্রহীন, সংজ্ঞাহীন।

 

 

 

 

আলিঙ্গন

 

একটা জ্যান্ত সন্ধ্যের অপেক্ষায় আছি

যবে আমার ধর্ম আমাকে জায়গা দেবে

মাথা নিচু করে হাসার, তোমার সোহাগ পেয়ে।

প্রতিটা ক্ষণ এখন শুকনো, কাঠখোট্টা,

প্রতিটা বিকেলে এখন তোমার ভীষণ ক্লান্তি।

সেই সন্ধ্যেটা জেগে উঠুক, জ্বালিয়ে দিক চারিদিক

তোমার চোখে চেয়ে।

তোমার চুলের জটে যতটা কান্না লুকানো আছে,

তোমার চোখের তলার কালিতে যতটা উপক্ষার আটকে আছে,

তাদের আমি শুষে নেব উপকরণ হিসেবে।

সেই সন্ধ্যেয়

আমি হাসতে চাই তোমার সাথে সভ্যতা!

 

 

 

 

 

 

৫।

 

জমিতে ছ্যাঁদা হয়েছে।

যে গাছ দাঁড়িয়ে ছিল বহুদিন

আজ তাকে বড্ড নড়বড়ে মনে হচ্ছে।

ওরা গাছটায় মিটিং ডাকত,

বসে বসে কূট-ক্যাচালও করত

এই কয়েকদিন আগেও।

ওরা পাখিরা

খুব নিষ্ঠুর, পরিযায়ী হয়ে গেছে,

অথচ পিতৃপুরুষ এখানেই মরেছে।

এখন শুধু একটা কাঠবিড়ালি থাকে,

একার রাজত্ব তার।

গাছটার খুব প্রিয় হলেও সঙ্গীহীন,

বোবার সাথে ওর বনে না,

জমির ছ্যাঁদাতেই ও নতুন ঘর বানাচ্ছে।

এদিকে ধীরে ধীরে গাছটা মিশছে

সেই ছ্যাঁদার গ্রাসেই।

আমি রোজ জানালা দিয়ে দুজনকে দেখি।

মাঝে মাঝে স্বপ্নে শুনতে পাই-

'বোবার সাথে থাকা যায় না!'

সম্যক সংসারী!

গাছটা কিন্তু

ধীরে ধীরে

ছ্যাঁদার ঘাড়ে যাচ্ছে।

 

 

 

৬।

 

আজ আবার হালকা ঝিরঝিরে, হাওয়াটাও কম।

আজও আলসেমি, আজ রাতেও কল্পনা।

ছোটবেলার গল্পগুলো যেকটা একঢিলে মনে পড়ে,

মনে করার চেষ্টা করলাম।

স্মৃতিগুলোকে দূরে ঠেলে

যে ঘামগুলো শিরদাঁড়া বেয়ে উঠে আসে বয়সের হাত ধরে,

সেগুলো আজ অনশনে বসেছে।

ইলশেগুড়িতে ওদের বড্ড এলার্জি।

ভাগ্যিস!

তবে আজ আকাশ কুচকুচে নয়,

রাস্তাটাও ভেজেনি বেশি আজ,

কুকুরগুলো শান্ত, মশাগুলো মশগুল।

অনশনের মিছিলে হেঁটে আমি চোখ বুজি।

আমার সাথে বৃষ্টি দেখে

লালকমল নীলকমল,

ওরাও চোখ বোজে, একসাথে।

ছেলেবেলা কিরকম চমকে ওঠে!

 

 

 

৭।

 

বহুদিন পরে পা ভিজিয়ে ব্যালকনিতে,

একটা চেয়ার, আমি, চারতলার বৃষ্টি আর

অন্ধকার আকাশ।

উচ্ছন্নে যাওয়া পচা সমাজের ঊর্দ্ধেও

কিছু জিনিস থাকে।

থাকে ভ্যাপসা গরমেও ঠান্ডা হওয়ার শিরশিরানী,

থাকে আন্ডার কনস্ট্রাকশন চারতলা বিল্ডিংয়ের বাইরে

ইঁটদের নিষ্পলক ভিজতে থাকা,

থাকে রবীন্দ্রনাথ।

আর থাকি আমি, কূলে একা বসে।

আজ কোন কঠিন কবিতা নয়,

শুধুই সহজ কল্পনা, ভালোলাগা।

একটা কালো আকাশ,

থেমে যাওয়া একটা বিল্ডিং

আর চারতলা বৃষ্টি।

 

 

 

 

রিহ্যাব

 

 

প্রতি ঘন্টায় শরীরে খিদে জাঁকিয়ে বসে।

একটা গ্রিনহাউস ঘরে একটাই জানালা-

একটু ফাঁক করা।

নর্দমা ডিঙানোর মত সেটাকে টপকে

ভিতরে আসছে ভিজে হাওয়ার একটা স্রোত।

শেষ প্রহরে ঘরের শ্বাসকার্য ঘন হয়,

কার্বন ডাই অক্সাইড বেরোচ্ছে একই পথে,

একটু শুদ্ধ হয়ে। অন্যভাবে।

উত্তম নির্বাপক এই বাতাস

বস্তির প্রতিটা গ্রিনহাউস থেকে বেরোয়

পুনর্বাসনের জানালা ধরে,

প্রতি ঘন্টার জমানো খিদে

শেষ প্রহরে নির্বাপিত হয়

অন্যভাবে।

 

 

 

 

 

 

ব্যাপ্তি নীল

 

 

প্রশ্ন করতে গেলে

চোখের নীচে যে উপক্ষার জমে

তা চিরস্থায়ী।

হার্টের বাঁধন ঢেলে সাজাব আমি

সেলগুলোকে ডিস্টেন্স-এ রেখে,

নিলয়ের তাপ মেপে।

 

পায়ের তলার রক্তের রং মেশানো।

উপক্ষারে স্যানিটাইজ হয়ে দৌড়নো রক্ত নীল,

ঠিক যেভাবে ব্যাপ্তি নীল, তিনভাগে, ম্যাপে।

 

আমি তবুও জিজ্ঞেস করি

নীল না এলে সাদা ফুটবে কিভাবে?

 

সময় দাও।

রক্ত আবার সাদা হবে।

মহাশিরাদের পাঁচিল সারাই হচ্ছে,

কোটরে বাঁধবে তোমায়

উপক্ষারের সাথেই।

আমি দেখব-

ব্যাপ্তি নীল, তিনভাগে, ম্যাপে।

 

 

 

 

ছুটি নিলে শিল্পী

 

 

তুমি ছুটি চাইবে, বিশ্বাস করিনি।

ঝড়ের রাতে নৌকোয় দাঁড়িয়ে

তোমার ফোকলা দেহের ফটোশ্যুট

আমাদের জৈষ্ঠ্য চিনিয়েছিল।

কথা ছিল তুমি ডিঙি সারাবে,

আর আমরা পাড়ি দেব আশ্বিনে,

বিসর্জনের গল্প শোনাব তোমাকে,

দোসর হবে কচি চাঁদ।

কিন্তু তুমি ছুটি নেবে, ভাবিনি।

 

যে পাখিটা তুমি দিয়েছিলে পুষতে

সেটা ঝড়ের মধ্যেই উড়ে গেছে

তোমার কথা ভেবে তোমার দিকেই,

তোমার মতই মেরামতকারী হতে।

 

কাজ শেষে শিল্পী যখন খোরাক হয়ে ওঠে

চিড় ধরে তার শিল্পে, তারই অভিশাপে।

এখন অজস্র ডিঙি ভেসে আসে পাড়ে,

ফাঁকা, ছ্যাঁদায় ভরা, ডুবুডুবু,

এগুলোই এখন বোধনের নৈবেদ্য।

ভাগ্যিস তোমার পাখি উড়ে গেছে!

 

বাজারী সভ্যতায় গা সইয়ে বরাবর

তোমার অনুরোধগুলো অবজ্ঞা করে গেছি।

ছুটির খামের ওপর হয়তো যথার্থই ছিল

তোমার উজ্জ্বল হাসিমুখ, সেবারেও উপেক্ষিত।

এই পচা ব্যাপারী-আরত

আমাদের হতভাগাদের দুনিয়া, তোমার নয় শিল্পী!

bottom of page