এই মাসের কবি : বৈদূর্য্য সরকার
আলাপ-পর্ব
৬ই মার্চ, ১৯৮৬ সালে উত্তর কলকাতায় জন্ম। বয়ঃসন্ধিতে এখানকার ম্যাজিক্যাল অলিগলিতে ঘুরে-বেড়িয়ে, কৈশোর থেকে গনগনে যৌবনে ঘরে-বাইরে যত্রতত্র নিরুৎসাহ হতাশা ও অপমানের পরে একঘেয়ে গ্লানিময় কর্মজীবন, দাম্পত্য ও সামাজিক টানাপোড়েন... সবকিছুর পরেও বসন্তজাতক বসন্তনেশা খুঁজে বেড়িয়েছে ধূসর কাগজে কালো অক্ষরের মোহে । বৈদূর্য্য সরকার হেরিটেজ একাডেমিতে কর্মরত ও "সুতানুটি আহির' পত্রিকার সম্পাদক। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ পাগলের গান ও মুখোশ, ঋতুকাহন, কোরাস ১ এবং ব্যক্তিগত বর্ডারে। বৈদূর্য্যকে যোগাযোগ করতে হলে ইমেল করুন: baiduryya.sarkar@gmail.com আর নজর রাখুন বৈদূর্য্যের ব্লগে: https://baiduryyas.wordpress.com/author/baiduryyas/
তার নামে
প্রথম ফাগুনদিনে কৈশোরোত্তীর্ন ছেলেরা ‘জয় রাধে’ ব’লে
চৈতন্য জন্মোৎসবে, কীর্তন আসরে কৃষ্ণ ফুটে ওঠে
অনুসরণের ইচ্ছে থাকলেও – সুযোগ হয়ে ওঠে না ।
বসন্ত সন্ধেয় কে হারিয়েছিল ঝাড়গ্রামে এস্কার্শানে...
সেসব ভ্রমণ আমরা পেরিয়ে এসে, দাঁড়িয়েছি
শুকনো শরীরে রক্তরঙে ফোটা পলাশ প্রহেলিকায় ।
কত কী যে ভেসে ওঠে বসন্ত নিউজফিডে
মৃদঙ্গ খোলের বোলে, কোথা থেকে কারা সব ভেসে আসে
তাদের ভুলে এগোতে হয় বাঁশি নামের প্রলাপে ।
মাঘের সুতানুটি গাঁ
বিরাট সামিয়ানার নীচে সারি সারি চেয়ার
আশপাশে মাঠ জুড়ে গোটা পঞ্চাশ দোকান,
সাজপোশাক চা সরবত কালনার মিষ্টি তেলেভাজা
গহনাবড়ি আনন্দমেলা লোহার কড়া খুন্তি দা
কাঠের চেয়ার থেকে হরেক মাল পনেরো টাকা...
ছেচল্লিশের দাঙ্গায় যে মাঠে উড়েছিল ছাই
সেখানে জেঁকে বসেছে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ।
রাজ্য এবং রাষ্ট্রের কোটি টাকার অনুদানে
জমে উঠেছে আসর ।
রসকলি খসে যায়, শুকনো চামড়া অতীত কাহিনী
হরিনামে জেগে ওঠে মাঘ মাসের ঠাণ্ডায়,
দু’হাত তুলে দুলকি চালে নেচে ওঠে বৃদ্ধ দেহ
ফচকে মেয়ের দল উলু দেয় কৃষ্ণনামে, মৃদঙ্গ বিভঙ্গে
জাগে ন’শো বছরের পুরোনো কাহিনী -
হুসেন শাহ মাত হয় কৃষ্ণলীলায়,
প্রেম ফিরে আসে ভ্যালেন্টাইন উইকে ।
আলোর মায়ায় মহিলার চেয়ারের পাশে এসে
দাঁড়ায় নীল বর্ণ দেবতা,
পুরুষের ধ্বস্ত রথ বয়ে নিয়ে যান ।
টাইম ট্রাভেলে আশপাশে জেগে ওঠে, নিশ্চিত সুতানুটি গাঁ
সুরের অনুসরণে কিংবা কাহিনীর অথবা চুঁইয়ে পড়া
ঐতিহাসিক সত্য আশ্রয়ে ।
সহজ এ নামে ভেসে যায় যাবতীয় আরবান ছবি,
বর্ম সব ভেসে গিয়ে জেগে ওঠে করুণ অন্তর
হাগ ডে’ কাউকে চায়... শীতের সন্ধেয় শ্রীকৃষ্ণ বিভ্রমে ।
চোখের পলকে
ছুটন্ত ফ্যান অফ করলে
দেখতে পাই ধুলো জমেছে,
জীবন থামলে বোঝা যায় – ‘মহামায়া পণ্ডশ্রম’ ।
ঝকঝকে রোদের দুপুরে শৈশব খোলস ফেটে
বেরিয়ে এসেছিল কৈশোর
অসম্ভব ঘাম ও উত্তেজনায়,
বিকেলগুলো ঝটপটিয়ে ফট করে মরে গেলে
সন্ধের আলো খুঁজেছে পার্কস্ট্রিটে উঠতি যৌবন
গড্ডালিকা স্রোতে গা ভাসিয়ে
মেটেনি কারো অনন্ত তৃষ্ণা,
হেমন্ত এসেছে বলে ঘোচে আমাদের সজলতা ।
অতঃপর ফিরে আসি খামতি নির্ণয়ে,
ব্যর্থতাকে ‘কৃতজ্ঞতা’ বলে
বাটপারি হওয়া জীবনে
হিমেল রাতের মানে দন্তশূল জানে
যার কথা মনে পড়ে, নাম রেখেছি পেনকিলার ।
মন্থরতা
টিপটিপ বৃষ্টি ছাতাছাড়া কার হাত ছুঁয়ে চলি
হেমন্ত আসে হাজার মোহে, ওড়নায় ফুটে ওঠে
অতীতের আলোছায়া... যাকে ছুঁয়ে দেখি
বালকের কৌতূহলে, ধারণ করেছি জীবনের পথে...
দু’চারটে ডিগ্রি গঞ্জনা চাকরি ব্যর্থতার পরিসীমা
হুল্লোড় থেকে সান্ধ্য বিলাসে সঞ্চয়ের পাত্র ভরে
অবসরের বৃষ্টির মতো ঝরে গেছে অবসর ।
বারান্দায় বসে দার্জিলিং টি’র সুবাসে মিশে দাম্পত্য কলহ
দড়িতে আধ শুকনো কাপড়ে জড়িয়ে আছে আগামীর মায়া ।
দূর থেকে দেখতে চেয়েও জড়িয়েছে ঝামেলায়
হারমোনিয়ামে বেজে ওঠে কাতর হেমন্ত গান ।
প্রস্তরীভূত
কিছু মানুষ বনের ফল খেয়ে বাঁচতো, তখন
আরেকদল শিকার করে ।
শিকারিরা অস্ত্রকে লাঙল করে ফসল ফলালো
জীবন যেভাবে সংসারে চাপা পড়লে
থেকে যায় নেশা হয়ে,
শিকারির বেদনা তেমন ছবি হয়ে
থাকলো গুহার দেওয়ালে ।
নয়ছয়
ভবযন্ত্রণা কথার মানে
মধ্যত্রিশ জানে...
শরীর বেঢপ হয়, মান ভাঙা মন
একা হাঁটার অবসর ফুরোয় যখন ।
ঘাম আর বৃষ্টি রামের সাথে মিশলে
থেমে যায় যান চলাচল, দুলে ওঠে চরাচর
দু’টোর সাথে একটা ফ্রি’র লোভে আমরা সবাই
শুষে নিতে চাই সমুদ্র বিশ্বাস ।
নিয়ন্ত্রণ
আধো অন্ধকারে কোনো পক্ককেশ কবি
যখন গোনেন নিঃশ্বাস, তরুণ কবির লেখা নতুন কবিতা
‘শাবাশ’ বলে ওঠেন, পিঠ চাপড়ে লেখা ছাপান...
তাদের মধ্যে নতুন করে জেগে ওঠে পরম্পরা।
বেঁচে ওঠেন ঈশ্বর গুপ্ত বঙ্কিমের হাত ধরে
গুরুদের কাজীর কপালে বসন্তটিকা আঁকেন
খালাসির দলে বেঁচে উঠে শক্তিদা বলে বসেন-
লিখতে পারছি না, এখন জয় জয়দেব লেখে ।
কেউ জানতো না এসব ঘটনা দূর থেকে দেখে
জীবনানন্দ ভাবেন- তার কি কোনও অপরাধ ছিল !
শুধু জানতেন আগামীতে প্রকৃত কবি জীবন
তাঁর মতো, অবহেলা আর সন্তাপে কাটবে ।
সুপ্রাচীন পরম্পরা অগাধ বিশ্বাস শুনতে ভীষণ ভালো হলেও
তা থেকে কোনওকালে নতুন কিছু তৈরি হয়নি,
বদলে তৈরি হয়েছে অনুকরণকারী ভাঁড়েরা
যারা মাতিয়ে বেড়াচ্ছে সরকারি আলোকিত মঞ্চ ।
ফেরার পথ
কার্তিক সন্ধে তাপ ফুরিয়ে
যুদ্ধক্লান্ত অভিমন্যু হলে
দু’দণ্ড এসে বসেছি দক্ষিণের এই জানলায় ।
অন্ধকার চোখে রেখে ভুলতে চেয়েছি
অনাবশ্যক আলোর রোশনাই,
পাশ থেকে কে যেন বলে উঠেছে
‘বাড়ি অন্ধকার হয়ে গেলো’।
উৎসবের জন্য লাগানো এলইডি আলো খুলে
আমাদের ফিরে যেতে হয় অন্তরঙ্গে,
যেখানে ঘিরে থাকে দুশ্চিন্তা
এবং যাহা সর্বগ্রাসী... অনন্ত অসীম অকৃপণ ।
যতদূর দেখা যায়
আমি অ্যাসাইলাম দেখিনি... যুদ্ধক্ষেত্র বেসক্যাম্প
শাসকের কারাগার আলো অন্ধকার কিছুই জানি না ।
জলসা সিনেমা নাটক এবং সংসার দেখে
পুরো বিষয়টা কল্পনা করে ভেবেছি
বিষাদের গভীরতম বন্ধুর নাম একাকীত্ব ।
কপাল
বৃষ্টিবিঘ্নিত দিনে তোমায়
ডাকওয়ার্থ লুইস থিয়োরির মতো মনে হয়।
যেখানে চাহিদা ক্রমশ বাড়তে থাকে,
জেতা ম্যাচ হেরে যেতে হয় ।