এই মাসের কবি : জারিফা জাহান
জারিফা জাহান নব্বই দশকজাত। ইলেকট্রনিক্স এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক। বর্তমানে একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। লেখালেখির শুরু বছর চারেক আগে। মূলত ফেসবুক দেওয়ালে আঁচড় কাটতে কাটতেই শুরুয়াৎ। ক্রমে কৃত্তিবাস,রক্তমাংস, কবিতা আশ্রম, রেওয়া, প্রবহমান, যুগ-সাগ্নিক ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি। "এই সময়' সংবাদপত্রের নেট এডিশনের ব্লগার ও গুরুচন্ডালি সহ বহু ওয়েবজিনে লেখা চলেছে সমান তালে। প্রকাশিত কবিতার বই মন্দ সাইদাতি (গুরুচন্ডালি, বইমেলা ২০২০), অন্ধকারের কোনও রংবোধ নেই(কবিতা আশ্রম, বইমেলা ২০২০)। জারিফার সাথে যোগাযোগ করতে হলে মেল করতে পারেন zarifahzahan@gmail.com এবং নজর রাখুন জারিফার ব্লগে :
https://www.guruchandali.com/user.php?blogger=1767500363549744
কবিতা
কমলা লেবু
শীতকাল এলেই বোরোলিন দুপুরেরা আমার সপ্তাহান্ত খোঁজে। রোদ পোহানো দুপুর। উলের কাঁটার দুপুর। চুলোয় গরম হওয়া জলের মতো সে দুপুর টগবগ ফুটতে ফুটতে মটরশুঁটি সবুজ হয়ে এলে এলোকেশী পা ছড়িয়ে দেয় ছাদে মেলা বড়ির গায়ে। আমরা সপ্তাহান্ত খুঁজি, চড়ুইভাতির আশায়। ওরা আমগাছের ছায়ায় ভারী বনভোজন নয়, বাগানবাড়ির দালানে ছত্রখান হয়ে থাকা পিকনিকও নয়। সেসব কাতরাবে ভেবে মাথা আঁচড়ালেই শরীরের বাকি অংশে মিশে যায় কমলালেবুঘ্রাণ।
আমার তখন মায়ের কথা মনে পড়ে, ছায়া আবহে। কমলা খোসার মতন মায়ের মুখটাও নরম উজ্জ্বল, যেন দু'দন্ড স্থির তবু দূর থেকে বুকে বিঁধে যায় সে অমোঘ আকর্ষণ। খোসার ভাঁজ খোলা মাত্রই একটা গোলাকার দুনিয়া বেরিয়ে পড়বে, সুরুৎ - মায়ের সাজানো সংসার। একটা কোয়ায় বাবার ওষুধ , একটায় ইলেক্ট্রিসিটি বিল....। অথচ প্রতিটার গায়ে সুতোর মতন ঝুলছে কত বিসর্জন : সস্নেহ দুই হাতে আড়াল করা জ্বর, অর্ধেক চাঁদ স্বপ্ন...অস্থিচর্মসার।
খেউড়
তোমরা সব এক এক আশ্চর্য পাখি, টুপ করে দুনিয়ায়
নেমে এসেছ, বলে কোমরে আঁচল গুঁজলেন মা জননী।
তোমাদের কেউ কখনও ঘাড় নিচু করে ফুল ফোটার শব্দ শোনোনি, তোমরা সব 'অ এ অন্ধদর্শন' বোঝার আগেই ঘূর্ণি মাত্রায় গড়ে ফেলেছ সভ্যতার শিলালিপি, বলে ব্যাগের চতুর্থ খাপে টিফিন গুছিয়ে দিলেন তিনি।
ভাতপাতে ডাল মেখে থাকে শান্ত শিথিল সুরে
বাকদেবীর ভরাট আঙুল নামছে ক্রমশ, শ্লথ
মাতৃগোলার্ধ ঘোরে জ্বলন্ত উনুন চারিপাশে- ব্রাত্য সংসারতলে বিজন ক্লান্তি পোড়ে।
শ্লেটে খড়িদাগ খাক হয়ে মুখ ফিরিয়েছে যে জরায়ু-অরণ্য
তাকে আমি কিবোর্ডে দংশাই কাব্য - অজুহাতে
ভাবি কী লিখিলাম, ওহো সুষুম্নাপ্রিয়া
আদতে এ খেউড়গাঁথা ব্যাকরণশূন্য, আস্ত গিলে খায়
অন্তর্যামী মা-মন আমার।
প্রেমিককে
তোমাকে বলা হয়নি। এত রাতে, দিনে দুপুরে, স্বপ্নে
কান্না পেলে তোমাকে সে কথা বলতে গিয়ে দেখি, ক্ষত।
অঝোর ঘুমে মুখ ডুবিয়েছে তোমার দুটো কাঁধ
যেটুকু ভিক্ষে জমেছিল চোখে, নির্মেঘ
মাথা রাখব বলে, তোমাকে, বাবা ভেবে
'আমেন' বলেছিলাম স্থির অভিভূত।
অথচ তুমিও বুক খুঁজেছিলে অভিধানে, ডুবে
শীতল স্বপ্ন একলা ভেসে গেলে ঘেমে ওঠে নাও
তোমার খুলির ভেতর মগজ নেই, ভাসছে
শ্যাওলাজন্ম : কারা যেন শিখিয়েছে "পুরুষের অশ্রু একান্ত...সভ্যতাহীন..."
আমাকে ঠাঁই দেবে কি এমন অপূর্ণতার কাছে
দু'দন্ড ছাইদান রাখ...ফলিডল...দৈববৎ।
অনাহূত
এমনও হয়, দু'একটা অনভিপ্রেত আনাজ নিয়ে এসেছি ব্যাগে
যেমন লঙ্কার সাথে শুঁটি
চালকুমড়োর সাথে লাউ
আলতাআলুর পাশে মুলো
তারা সব মৌলিক অথচ রঙের সীমান্তবর্তী
বেখেয়ালে চলে আসে কখনও, অনাহুত, স্রোতে গা ভাসাতে।
এমনও হয়, আমাদের স্নায়ুছেঁড়া উৎসবদিনে
ডানাহীন এসে পড়ে খুন
ধর্ম আর রাজনীতির ফাঁকে
অপাঙ্গ ধর্ষিত খাটিয়ায়
তারা সব নিয়মিত অথচ মুখোশের কাছে
মুখ ফেলে এসে খুঁজে ফিরি
তৃতীয় পৃথিবী, প্রীতিভাজনেষু, স্বার্থের আরাম।
মহানাগরিক
মহানগরের মতন তোমায় মনে হয় বিশাল, ব্যাপ্ত, বহুক্ষণ ও জন ব্যাপী। সেই কোন প্রাক্কালে, ভিটেমাটিটুকু জড়ো করার সময় একখানি নিজস্ব বাসার স্বপ্ন দেখেছিলাম তোমার গহীনে, তোমারই হাতটি ধরে। এই যে পুরোনো আলোচাল, কোন এক দোকানীর থেকে ধারে আনা টুঁটি-ফাটি আনাজ , কুচো-লঙ্কাটি যত্নসহকারে কোঁচড়ে ফেলে ভীতপায়ে মহানগরে পদার্পণ করা গেঁয়ো-মফস্বলী মেয়ে...যার চোখ চিকচিক করে অনাগত গুম্ফহীন ভবিষ্যগাঁথায়, আমিও তেমনি বহুলাংশ পেছনে রেখে পরিব্রাজক হয়েছি, তোমারই মুখাপেক্ষী, মানচিত্রে ঠাঁই পাবার আশায়। ভালবাসলেই বিষাদ এত সুনির্মল হয় কেন, বলো তো? পথের শুরুতে যে স্বপ্ন ঘনঘোর, শহরতলি-নগরের মিলন হতে পারতো যে কাহিনীর শেষে, গুহাচিত্র পেরিয়ে তবু একটিবারও নিজেকে উজাড় করে নতজানু হতে পারলে না কেন....হে মহানাগরিক! যাত্রাপথে এত ঝড় হল, সহসা বায়ুবেগ, গতিপথে এমত আন্দোলন, ভয়ানক....অথচ সে ঝড়ের সাক্ষীস্বরূপ শুধুই খসে যাওয়া পাতাদের গুঞ্জনঅবশেষ.. আমাদের ইতিহাসে, অসময়ে ঝরে পড়া ঝড়ে যেন বিমূর্ত কোটি বছর পূর্বেকার যতিচিহ্নহীন দীর্ঘশ্বাস।
সেই শহরতলির অবুঝ মেয়েটি, বহুলাংশ থেকে খই ছড়াতে ছড়াতে সর্বস্ব গচ্ছিত রেখেছে যে, একান্তই তোমাকে বিশ্বাস করে, তাকে দু'হাতে টেনে বুকে চেপে ধরতেও পারতে...উদাসী চোখে সুখ-শান্তি চেয়ে ঘরে ফেরা মানুষের কোলাহল দেখতে দেখতে যদিও'বা অশ্রু ফেলেছে সে কয়েক-মুকুত, মুহূর্তপ্রেমে চুলে তার বিলি কাটার অজুহাতেও আপন ভাবোনি তবে তাকে একটিবার.. সে কথা কি বুকে হাত রেখে বলতে পারো 'বিশ্বপ্রেমিক'? এত যে মানুষ, এত প্রেমিকা...বহুবিধ পথ ধরে দিনান্ত চলেছে তোমারই গন্তব্যে, তাদের সেতুপথ-বিনির্মাণকাল কি তবে ক্ষণজন্মা? যদি না হয় সে উত্তর, স্বতন্ত্র শহরতলিটিতে ফেরবার শেষ ট্রেন বাতিল করা থেকে বিরত হয়ো.... নচেৎ....উদ্দেশ্যহীন-আমোদহীন-প্রেমহীন-প্রতিহিংসাহীন এক জীবনের ভূপর্যটন সফরের আগে পথিকের আত্মহত্যা শ্রেয়।
হ্যালিলুয়া
গভীর বিষণ্ন সন্ধ্যা এলে আপনাকে মনে পড়ে
অকপট, কথা জমা ছিল। ভেবেছি নক্ষত্র দিয়ে
কিনে দেব কোজাগরী। স্তব্ধতা ফুরোবে কফিঘরে,
হেঁটে যাব আজীবন জন্মান্তর; শপথে, পেরিয়ে।
মনে আছে খ্যাতিহীন কোন ফসিল-দিনের কথা?
সন্ধ্যাতারা বুকে নিয়ে হাতে হাত, ম্লান অঙ্গীকার।
এখনও সে প্রতিশ্রুতি, ছেড়ে গন্তব্য আলেয়া পাতা,
দূরত্বে ভ্রান্তিবিলাস মুখোমুখি হয় পরস্পর।
বহুবার ফিরে গেছি চেনা রাস্তা, স্মৃতির জাফরি।
ওপারে কি অনপেক্ষ কোন এক নিষ্ফল প্রহরী?
আজকাল দিনশেষে, স্থির দেখি সিগন্যাল বাড়ি
অবসরে মুখাপেক্ষী, তবুও তৃতীয়, নরনারী।
আদতে বিরামহীন। শূন্যের সাথে শূন্যের যোগ,
অবশেষ ফেলে গেছে নামান্তরে, অভ্রান্ত বিয়োগ।
পর্দা
হামিদুল্লা এসো, এই ধূসর রঙা সন্ধের দিকে মুখ করে বসো, অবিন্যস্ত। সিগারেটের গন্ধ ভেঙে ভেঙে একটি ত্রিমাত্রিক ধর্মযুদ্ধের সূচনা করতে পারো বরং এই নিদাঘসংকটে। ওই যে দূরে বন্ধ বস্তাটিকে দেখছো সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টিতে, উহার আবিষ্কর্তা হতে পারো তুমিই। শুধু কল্পনা করো একবার, সোনার বদলে পেলে রক্তবর্ণ সরীসৃপদেহ। গোপন আমিরশাহী বাসনাকে আলখাল্লা পরিয়ে কীভাবে অস্পৃশ্য রাখবে তখন, হতাশা ঘন হয়ে এলে ? আরবী হরফের নিশাচর সঙ্গমপাখিটিকেও পেতে পারো দুর্গন্ধপরায়ণ তীব্র নজরদহে।
হামিদুল্লা ভাবো এইবার, পার্থিব নারীকে, তোমারই স্ত্রী-সন্ততি; চক্ষুদু'টি উন্মিষিত, পদ হইতে মস্তকের মাঝখানে বিষাদকালো পবিত্রতার বেড়িবন্ধন। উহারা বদ্ধ , বন্ধ এবং বস্তাবৎ। 'প্রিয়' নারীটির মুখে পর্দানশীলনিগম গুঁজে দিতে দিতে ভাবো, দ্বিতীয় হামিদুল্লার কথা। জেনো, গত সন্ধেয় খননকার্যপূর্বে যে লোলুপদৃষ্টিফল্গু রেখেছিলে সন্দেহজনক বস্তাটিকে ঘিরে, তাহা একান্তই শ্রেষ্ঠ পন্থায় প্রকাশিত রিপুনীতি; পর্দা ও বস্তা উভয়েই সূর্যোদয়দৃশ্য হইতে বঞ্চিত।
সুন্দরবন
ঈশ্বর নই। আগামী কৃপাবন্ধু, অজানা নিদান
অতএব তোড়জোড় সুচারু, মনেতে বরাভয়
ভুল না নিতে জাহ্নবী, চেরাজিভ জগদ্দল টান
এভাবে তালিকা দীর্ঘ হয়, এভাবে গরলক্ষয়
একা অধীশ্বর, ধীর প্রহরস্থির, আঠারো ভাটি
পৌঁছাব মল্লার ভ্রমে, অনাগত স্রোত মৃদু দ্বারে
কত স্বপ্ন হুড়ো দেয়, শীত-মরুত উলুধ্বনিটি
স্ফুরনাগরিক তবু ফিরিয় না অবহেলা ভরে
আমাকে চেন না জানি, স্বাভাবিক, কী'বা পরিচিতি
যারা দুলাল-দুলালী, ভিক্ষাপাত্রে রাখে উচাটন
প্রাণ, কবচ-কুণ্ডলহীন আমার সমিধতিথি
বন্ধক উঁচু সিন্দুকে, সুবিধার সারসত্য মন
অথচ বিশ্বাস কর, পুজো শেষে গাছতলে থাকা
তোমায় মনে করব, বিরতি, শ্রাবণ মাটিমাখা।
ভিডিও গেম
এই রেখা; এ বরাবরই ক্ষমতাতন্ত্রের ভুজ্যি পরিসর।
একখানা আজ্ঞাচক্রে সভ্যতা- সন্ধ্যারতি হয়
শ্মশানবান্ধব, অথচ তুমি সম্বৎসর,
রাষ্ট্রের দিকে পৃষ্ঠপ্রদর্শনে ধ্যানমগ্নময়।
আমাকে সুতোয় বেঁধেছ মেয়াদকালীন
লাশের স্তুপ ডিঙিয়ে ছুটছি ধর্মঘট-ভাতের দিকে, অক্লান্ত দৌড়বীর।
বেশ তো সারাৎসার, আপাদমস্তক মরীচিকাজ্বর। মূষিকপ্রসব পূর্বে আরও নাচাও, হে প্রভু, যেভাবে মাতাল বাঁদর নাচে কার্নিশে, কেলিয়ে দাঁত, দ্বিপ্রহর।
বিশ্বাসহন্তা
তাবৎ প্রসব-মল্লভূমিটির মুখে
গুঁজে থাকে লাল ধাগা, জন্মদ্বার যেন।
মাজারের ফুল-শিন্নি মনে পড়ে এই সময়, মনে পড়ে পীরবাবাজিকে, স্বর্গত ক্ষমতা বানে
অবশ্যম্ভাব পুত্রলাভমোহে তাঁহার সহিত সঙ্গমদৃশ্য। দরজায় প্রহরারত ভাতারটিকেও মনে পড়ে
মোর, জ্বালাধরা দীর্ঘশ্বাসে।
যে ভ্রমণপর্বে চামতাবুরু উঠে আসে অকপটে অথচ
ইবলিসাবতার শহুরে বাবুটি এখনও সমক্ষে ভণিতা
রাখেন, সাঁওতাল রমণীর বুকের ভাঁজে যৌন আন্দোলনের
আক্ষেপ তিনি রাখেননি, তাঁর
আমোদী জীপগাড়িটি দেখে শীত আসে অতর্কিতে।
কেদারায় উপবিষ্ট অষ্টপ্রহরা রমণী তাঁহার
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে স্মরণ করেন মাসমাইনের ধুলোর
ভেতর উচ্ছিষ্ট আতুপুতুভালবাসা।
অথচ 'অপুত্রক জীবন হইতে মৃত্যু শ্রেয়' একথা দেওয়ালে
ছুঁড়ে দিয়ে পাহাড়সফরে গাইড হয়েছিলেন
মোর ভাতাররাজ। কুয়াশা-চশমায়,
বাবুসাহেব আপনাকে, আদিবাসী নিতম্বছায়া
ঘেরা একটি সর্বনাশাগোধূলির আয়োজন করতে ব্যর্থ
সোয়ামী মোর, বিদায়পূর্বে জানিয়ে গেছেন তিননম্বরটি
হায় আল্লাহ, খোদার কিরে, বাবাজীর পানিপড়াতে,
এ যাত্রাও মেয়ে হলে কালো কুৎসিত এই রুক্ষ্ম
প্রদেশে আমার, পদছাপ আঁকা হবে আঁচল ভরতি বাসি নুনদাগে।
এইসব মনে এলে সদ্যজাতাকে বুকে তুলে নিই উৎসাহী
ডাইন; নামাই বৃন্ত, স্তনবৃন্ত, তার মুখে। ব্যর্থ
সিজদায় মস্তক ঝুলে থাকবার চেয়ে এই শ্রেয়
টিপে ধরা নবাগত শ্বাস
দুই স্তনের ভেতর, পিষে ফেল শ্বাপদ জনম।