top of page

এই মাসের কবি : অরিন্দম ভূঞ্যা

আলাপ পর্ব

WhatsApp Image 2021-04-30 at 11.56.22 AM

অরিন্দম ভূঞ্যা'র জন্ম 1985 সালের 16ই এপ্রিল, কবিতায় জেগে থাকা এবং কবিতায় ঘুমিয়ে থাকাতেই তাঁর শান্তি, এ পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ দুটি, প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'যেটুকু পাতার শব্দ'- ('সপ্তর্ষি প্রকাশন', জানুয়ারি 2018),  দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'হাওয়া ও স্ফুলিঙ্গ' ('আদম', কলকাতা বইমেলা 2020), তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে মেল করুন এই ঠিকানায়: arindambhunia7@gmail.com

 

কবিতা

 পদযুগল


আমাদের কাদামাটির হৃদয়,  নিচু খড়ের চাল,  ঝির ঝিরে
এক পশলা বৃষ্টি,  এসব সে নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছে
দুহাতে নটে শাকের বীজ,  বারোজনের হেঁশেল, আমরা অবাক হইনি,
গাভীর মতো শান্ত দুটি হাত, নিঃশব্দে ভরে দিয়েছে
আমাদের পেয়ালা,  তৃপ্ত হয়েছি,  আমরা জানতেও চাইনি
তার উপবাস,  মঙ্গল কামনার ফুল সে কিভাবে
সুউচ্চ প্রশাখা থেকে চয়ন করল

এ সংসার তার কিছুই জানেনা...

কেবল শঙ্খ হাতে দিয়ে বলে দেবতাকে ঘরে আনো
পৌর্ণমাসী সন্ধ্যায় সে তখন একগুচ্ছ তারাদের সঙ্গে
রেশম রেশম সখীদের সঙ্গে জলের গভীর থেকে দেখছে
ঘটোত্তোলন,  নিঃসঙ্গ দুর্বা-র ভেসে যাওয়া...

স্নিগ্ধ পদযুগল,  আমাদের লতানো বিরুৎ চোখে টোল রেখে
ফিরে গেছে,  সাদা ও ঈষৎ লালচে হয়ে ফুটে আছে
এক একটি ফুল কুড়োতে কুড়োতে তাঁর গৃহে এসে দেখি

সালাংকারা দেবী রাত্রির আহার প্রস্তুত করছেন

 

 

হেমন্তের শিশুরা খুব কাঁদে


একহাতে বলদের দড়ি,  অন্য হাতে উঁচু ঘাসের বীজ
ছড়াতে ছড়াতে বাবা নদীপথে মিশে গেছে,
মা-ও ভোর ভোর গৃহকর্ম সেরে সেই ফসল কাটবে বলে
সূর্যের দিকে চলেছে হেঁটে, শুন্য উঠোন---
চার বছরের বোন দু’বছরের ভাই কোলে, টলমল পায়ে দাঁড়ায়
অমনি গাছেরা এগিয়ে দেয় শাখা
ফুলেরা গোল হয়ে ঝরে পড়ে, বিষাক্ত সূঁচোলো কাঁটা
অন্তরে লুকিয়ে বনের কুলেরা পেকে লাল হয়ে ঝুঁকে পড়ে
পাতার মুকুট পরে এইবার অস্ত্রশিক্ষা হবে
কুকুরছানা আর ছাগলছানারা গা ঘেঁষে দাঁড়ায়
বালক সৈন্যের দল ছেড়ে দেয় অশ্বমেধ ঘোড়া
বল্মিকের ঢিবি পেরোয় গোপালকের দেশ, শান্ত ডোবার জলে
পুটিমাছের ঝাঁক দেখে থামে, গড়ে ওঠে প্রাচীন সভ্যতা
বালির ঘর, পাতার ছাউনি, ঘর ভাঙ্গে আবার গড়ে,
ভাঙতে গড়তে ঘুম পায়
খিদে পায় মা...


 

 

 

ধীবর


কত ক্ষুদ্র এই প্রাণ, বৃষ্টির ফোঁটার চেয়ে ক্ষুদ্র
তাকে ডাকে, সে অত্যন্ত ধীরে,
তার ছোট নৌকা যখন মাঝ নদীতে,
দু’পাশের অশ্বত্থ বট আর উন্মাদ হাওয়া
একখণ্ড মেঘ ভাসিয়ে দিল, কেঁপে উঠল সৌর পথ
ভাবি, ওই কালোরঙের পলকা ডিঙিটি, কিভাবে যে
অতল গভীরে সংসার প্রমাণ মেঘ ঠেলে ঠেলে এগোয়
আর মেঘের ভেতর থেকে লাফিয়ে ওঠে মৌরালা মাছেরা
যেন বড় ফাঁকের জাল, জাল নয় খেলার জানালা
সেই জানালা দিয়ে অতি ক্ষুদ্র, সাদা, চকচকে
চুনোপুঁটিরা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিদানা হয়ে ক্রমশ
জল স্থল অন্তরীক্ষ ঢেকে ফেলছে

তাদের এলোমেলো খুশির কতটুকু ধরতে পারে
ছাপোষা ধীবর?


 

 

 

কাঁটা বাঁশ


দেখেছি কাঁটা বাঁশের ভেতর
তুলতুলে ডাহুক শিশুরা কি আনন্দে খেলে বেড়ায়
নিশুতি রাতে ঘন পাতার ফাঁক গলে
সরু সুতোর জোৎস্না যখন নামে
একেকটি কোঁড় আর ফ্যাঁকড়া ছড়ায় দিগন্তে
ছড়াতে ছড়াতে একসময় মানুষের মনের মধ্যে ঢুকে পড়ে
তখন কত বিচিত্র দিকে তাদের গতি, কখনো
সোনালী মেঘের দিকে ছুটে যাচ্ছে, কখনো গৃহস্থের
সুখ-দুঃখ বিবাদের কথা মাথা নিচু করে শুনছে
কখনো আবার সারাদুপুর থমথমে ছায়া হয়ে ভাবছে তো ভাবছেই,
মন কি এত সহজ বিষয়?
স্বয়ং ব্রহ্মাও তার গোড়া খুঁজে পান না
পচু লোধা এবছর যত কাঁটা ছাড়ায়, পরের বছর
দ্বিগুণ উৎসাহে কাঁটাঝোপ ঘন হয়ে ওঠে, এইভাবে
কাঁটা ছাড়াতে ছাড়াতে বৃদ্ধ বয়সে এসে ভাবে
মনটি তার এখনও কত সবুজ আর ছনছনে রয়ে গেল
দেহ যখন আগুনে পুড়বে, এই মনও পুড়বেতো?
আর এই সাত-মহলা সাম্রাজ্য যদি পোড়ে
পৃথিবী কি পারবে নেভাতে তার শিখা?

মনে পড়ে,কতবার খালপাড়ের কাঁটাবাঁশের বনে

আগুন লাগিয়ে 'হোলি হ্যায়' বলে ছুটে পালিয়ে এসেছি
                            

 


 

 

 

হিপহপ যেমন হয়


কিছু কিছু নাচের ভঙ্গি ফ্লোরে হয়না
হয় বন্ধ ঘরের আড়ালে, স্কুল-বালকের চান করবার সময়
কিংবা ঘাড়বাঁকা মহুল গাছের প্রশাখায়
বেগুনবাড়ির কাকতাড়ুয়া কিভাবে যে সেসব শিখল!
বাঁকা কোমর, ছড়ানো হাত, হিপহপ যেমন হয়,
ঠিক সেইভাবে নাচতে নাচতে কখন যে তার
মাথাটি খুলে পাশে পড়ে ভেঙে গেছে!
আর এই রূপ দেখে, একহাত কোদালের বাঁটের ওপর রেখে
স্মিতহাস্যে অর্ধকৃষ্ণের ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছেন
আমাদের চাষীভাই,
দেখছেন আনন্দ কত ভাঙা, কত ছেঁড়া, কত হাওয়া...
আনন্দের শরীর নাই
                          

 

 

 

ধরিত্রী


শীর্ণ নদীটি তার জন্মদাতা পর্বতকে টানতে টানতে
মোহনার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তুষার যুগের পর
এই অলীক দৃশ্য একুশ শতকে আবার দেখা গেল
নদী এখন ছিপছিপে সদ্য যুবতী আর পর্বতটি
ক্ষয় পেতে পেতে ঢাউস একখান ট্রলিব্যাগ হয়েছে
বন্ধুরা, এবার সকলে একসঙ্গে মনোযোগ দিন
এমনভাবে দেখুন যেন ওই সামান্য ব্যাগে লুকোনো আছে
মানব সভ্যতার ইতিহাস! দেখতে থাকুন মেয়েটির
পাপড়ি মেলা শ্বেত পদযুগল, ক্ষীণতম কটি আর
যৌবনের মধু ভরা বক্ষদেশ ঠিক আপনার মনোমতো
হয়ে উঠেছে কিনা, তার পরেও ধৈর্য যদি থাকে
দেখুন কি নিখুঁত কাজলে পথ শ্রমের ক্লান্তি ঢেকে
মরু এবং অরণ্যের পর রাজপথ ভাসিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে

জগতের এত ভার বহন করবার ক্ষমতা সে কোথায় পেল?

 


 

 

 

শিকার


শতাব্দী প্রাচীন এক ঝামাপাথরের খাঁজে ছিল ঘর
মৃত্যুর বাসনা ছিল চাঁদের আগুনে কিংবা দাবানলে
আজ কি ভেবে, দূর একটি কুটীরের আলো দেখে
সে এক লাফে সহস্র বছর পেরিয়ে এল, তারপর
এক পা খেজুর গাছের মাথায় অন্য পা কাঁচা বাঁশের ওপর রেখে
ঝুপ করে ঢুকে পড়ল ঘরে
তার অন্ধকারময় জীবনের এই তবে আলোকপ্রাপ্তি?
আলোটি এত নরম কাচে ঢাকা যে, পোড়ে না পা পোড়ে না ডানা
শরীর আরো হালকা হয়ে নেচে নেচে ঘোরে
ঘুরতে ঘুরতে জানতেও পারেনা ওই নরম আলোর ভেতর
গোল হয়ে ঘিরে ধরছে একদল পুরুষ নারী শিশু
ম্যামথ শিকারের ইতিহাস তাদের রক্তে
হাতে প্রথম প্রস্তর যুগের ভোতা পেপার ওয়েট
মাথার ওপর নিঃশব্দে তীর নিয়ে দাঁড়িয়েছেন কালপুরুষ

পালাবে কোথায় পতঙ্গ!


 

 

 

মহাজাগতিক


চেনা মুখ সে ঘুরে ঘুরে দেখে, পৃথিবী যেমন ঘোরে
তার ঘূর্ণনে গহনার সূর্য আছে, রাত্রির কাজল আছে,
সেই প্রসাধন, তার সম্ভ্রমের বেণী, হাল্কা নড়ে উঠল,
ছড়িয়ে দিল ধ্বনি ও সুগন্ধ
এত ক্ষীণ, যেন দূর আকাশ থেকে যারা শুনেছিল
সেই নক্ষত্র যুবকেরা ঘন হয়ে এল, বন্ধু হল,
ঢলে পড়ল আনন্দে, তাদের হাসির ফোটন
এই ভোরের স্টেশনে গুঞ্জন ছড়িয়ে দিল

শালিখ দম্পতি বোঝেনা এসব, কেবল আলো খুঁটে নেয়





 

 

 

ডুব


উত্তেজনায় কাঁপছে জল, কাঁপছে জলের আকাশ, কাঁপছে ডানা

এসময় তিনি বললেন
‘লক্ষ্যবস্তু ছুঁতে চাইলে মনকে আরো শান্ত হতে হবে'
এই শুনে একটি ঝুঁকে-পড়া ডালে মাছরাঙা স্থির হয়ে বসল
‘কি দেখছো মাছরাঙা?' এবার তিনি জিজ্ঞাসা করলেন,
-শান্ত জল, শান্ত আকাশ
'মূর্খ শিকারি, দৃষ্টিকে আরো গভীরে নিয়ে যাও, বলো কি দেখছ'?
-নীল আকাশের ভেতর সুদর্শন চক্র, চোখ ঝলসে যাচ্ছে,
‘দেখো দেখো আরো ভালো করে দেখো মাছরাঙা, মাছের চোখ দেখতে পাচ্ছ?'
-আহা, কত ছোট ছোট রুপোলি অক্ষর!
-কি অপূর্ব জলের কবিতা
-ভাসছে, আবার ডুবে যাচ্ছে


 

 

 

ভ্রমর


তোমার ক্লান্ত দুটি চোখ, ঘর্মাক্ত গাল আর ঝুলে পড়া স্তনের সঙ্গে
কোনও ফলেরই এখন সাযুজ্য নেই
তবু মৌমাছির দল তোমার দিকে মাতাল হয়ে উড়ে আসে
তুমি তাদের সামনে কিছু মৃত ফল সাজিয়ে রেখে ভোলাও
আমরা যারা গতজন্মে তোমার চতুর্দিকে উড়ে উড়ে তোমাকে পাইনি
এ জন্মে তারা গোল হয়ে ঘিরে ফল কিনতে দাঁড়িয়েছি
দাম কমাবার ছলে তোমার সঙ্গে একটু গল্প করছি
মনেপড়ে গতজম্মে তুমি ছিলে রাজকুমারী, আমি তোমার গোপন প্রেমিক
এ জন্মে তুমি ফল-ওয়ালি হয়েছ, আমি কোন বহুদূরের কৃপণ মাস্টার

তবু দেখো আমাদের মাঝখানে কি রকম
আপেল বনের সুবাস বইছে

bottom of page